ক্ষমতাসীন বিজেপি কি ভীতি ছড়াতে চাইছে? গুজরাটের দাঙ্গার দিন ফিরিয়ে আনতে চাইছে? মোদী কী মসনদ হারানোর ভয়ে আছেন? কী ঘটনা ঘটলো দেখা যাক:
রাজস্থানের একটি মসজিদের ভেতরে এক মৌলবিকে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে খুন করার তিনদিন পরেও অভিযুক্তদের খুঁজে বের করতে পারেনি পুলিশ। এমনকি কেন তাকে হত্যা করা হয়েছে, সেই কারণও তারা জানাতে পারেনি।
শিগগিরই এই হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের গ্রেফতার করা হবে বলে পুলিশ দাবি করলেও গোটা বিষয়টি নিয়ে স্থানীয় মানুষের মধ্যে ক্ষোভ রয়েছে।
আজমের জেলার অন্তর্গত রামগঞ্জ থানার সিঁড়ি বেয়ে উঠছিলেন একজন বৃদ্ধ ও কয়েকটি শিশু। কুর্তা পাজামা পরিহিত সবার চোখে মুখেই হতাশার ছাপ ফুটে উঠছিল।
নিজের ভাতিজা আর কয়েকটি শিশুকে নিয়ে ওই বৃদ্ধ এসেছিলেন মাওলানা মাহিরের হত্যার ঘটনায় নিজেদের বক্তব্য রেকর্ড করাতে। এরা সকলেই উত্তরপ্রদেশের বাসিন্দা।
মসজিদে যেভাবে খুন হলেন মাওলানা
মোহাম্মদী মসজিদটি রাজস্থানের আজমের জেলার রামগঞ্জ থানা থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে কাঞ্চন নগরে অবস্থিত। মসজিদের সামনে কিছুটা ফাঁকা জমি পড়ে আছে আর ভেতরে সাদা পোশাকের কয়েকজন পুলিশের সদস্য বসেছিলেন।
প্রায় চারশো গজ জমির ওপর নির্মিত মসজিদ চত্বরে ঢুকলেই ডান দিকে মূল মসজিদ আর তার সামনে একটা ঘর।
ঘরটি পুলিশ তালা বন্ধ করে দিয়েছে যাতে ভেতরে কেউ যেতে না পারে।
এই ঘরেই ২৭শে এপ্রিল রাত আড়াইটা নাগাদ মাওলানা মুহাম্মদ মাহিরকে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হয়।
ময়নাতদন্তের পর মাওলানার পরিবার মরদেহ উত্তরপ্রদেশে নিয়ে গেছে। তাকে সেখানে ২৮শে এপ্রিল কবর দেওয়া হয়েছে।
মাওলানার হত্যার পরে মুসলমান সম্প্রদায় আজমেরের কালেক্টরের অফিসে বিক্ষোভ দেখিয়ে অভিযুক্তদের গ্রেফতারির দাবি তোলে।
পুলিশ কী বলছে?
রামগঞ্জ থানার ওসি রবীন্দ্র কুমার খীঁচি বলছিলেন, "২৭ তারিখ রাত তিনটে নাগাদ থানায় খবর আসে যে মাওলানা মুহম্মদ মাহিরকে খুন করা হয়েছে। আমরা ঘটনাস্থলে পৌঁছে জানতে পারি যে তিনজন অপরিচিত ব্যক্তি এসে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে তাকে খুন করেছে।“
মৃত মাওলানার কাকা উত্তরপ্রদেশ থেকে এসেছেন। তার বয়স ৫০ বছর। থানায় বয়ান রেকর্ড করার জন্য তিনি আজমেরে থেকে গেছেন।
তিনি বলছিলেন, “আমরা চাই দোষীরা ধরা পড়ুক এবং কঠোর শাস্তি পাক। পুলিশ আশ্বাস দিয়েছে দোষীদের ধরা হবে, কিন্তু এখনও পর্যন্ত কাউকে গ্রেফতার করা হয়নি।“
মোহাম্মদী মসজিদের কাছেই থাকেন শোয়েব। তার সঙ্গে মাওলানার আলাপ ছিল।
তিনি বলছিলেন, 'আমাদের দাবি খুনিদের দ্রুত গ্রেপ্তার করতে হবে আর তার পরিবারকে দুই কোটি ভারতীয় টাকা ক্ষতিপূরণ এবং পরিবারের একজনকে সরকারি চাকরি দিতে হবে।“
তিন দিন পরেও কেউ গ্রেফতার হয়নি
মাওলানা মুহাম্মদ মাহিরকে হত্যার পরে তৃতীয় দিন, ২৯শে এপ্রিলও আসামিদের কোনও খোঁজ পায়নি পুলিশ।
থানার ওসি মি. খীঁচি অবশ্য বলছিলেন, “ঘটনাস্থলে ফরেনসিক দল আর ডগ স্কোয়াড ডেকে প্রমাণ সংগ্রহ করা হয়েছে।
"থানায় একটি এফআইআর দায়ের করা হয়েছে, তদন্ত চলছে। এখনও পর্যন্ত কাউকে গ্রেফতার করা হয়নি। ওই তিনজনকে গ্রেফতার করা গেলে হত্যার কারণ আর অন্য কারা এতে জড়িত আছে, সেসব জানা যাবে।“
সিসিটিভি ও অন্যান্য কারিগরি সহায়তা নিয়ে অভিযুক্তদের ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।
এই হত্যাকাণ্ডে কি কোনভাবে সাম্প্রদায়িকতা জড়িত আছে?
এই প্রশ্নের উত্তরে থানাও ওসি বলেন, "সাম্প্রদায়িক কোনও ব্যাপার এখনও পাওয়া যায় নি।“
মসজিদের দেখাশোনার দায়িত্বে থাকা আসিফ খান বলছেন, “পুলিশ যদি দ্রুত গ্রেফতার না করে, তাহলে সমাজের মানুষের মতামত নিয়ে আমরা পদক্ষেপ নেব, আমরা ধর্নায় বসব। ঘটনার পর থেকে মসজিদে যে শিশুগুলি থাকত, তারা মসজিদটির সাবেক মাওলানা জাকির সাহেবের বাড়িতে থাকছে। এখন মসজিদে কেউ থাকে না, মানুষ শুধু নামাজ পড়তে আসে।“
প্রত্যক্ষদর্শী কয়েকটি নাবালক
মসজিদ চত্বরে যে ঘরটি আছে, সেখানেই মাওলানা মুহম্মদ মাহিরের সঙ্গেই থাকত উত্তরপ্রদেশ থেকে আসা ছয়টি নাবালক শিশু।
ঘটনার সময় মাওলানা মাহির আর ওই শিশুরা সবাই একসঙ্গে একই ঘরে ঘুমোচ্ছিলেন।
রামগঞ্জ থানায় নিজের বক্তব্য রেকর্ড করার পর ওই শিশুদেরই একজন, সাজিদ (নাম পরিবর্তিত) বলছিলেন, "আমি দু'বছর ধরে মসজিদে পড়াশোনা করছি।
“খাওয়ার পরে আমরা সবাই মাওলানা সাহেবের সঙ্গে ঘরে ঘুমিয়ে ছিলাম। হঠাৎ কিছু লোক এসে মাওলানা সাহেবকে লাঠি দিয়ে মারতে থাকে, তখনই আমরা সব বাচ্চারা জেগে উঠি।
''ওরা তিনজন লোক ছিল। সবারই পরনে ছিল কালো পোশাক এবং মুখে মাস্ক, গ্লাভস পরা হাতে লাঠি ছিল।“
ঘটনার বিবরণ দিতে গিয়ে সাজিদ বলছিল, "ওরা আমাদের হুমকি দিয়ে ঘর থেকে বের করে দেয়। ওই তিনজনের মধ্যে একজন আমাদের পাহারা দিচ্ছিল। সে আমাদের হুমকি দিয়ে বলে যে আমরা যদি কোনও শব্দ করি বা চেঁচামেচি করি তাহলে আমাদেরও মেরে ফেলবে।''
কিছুক্ষণ পর পেছনের দেয়াল টপকে সবাই পালিয়ে যায় বলেও জানায় সাজিদ। বয়সে বড় দুজন মাওলানা মুহাম্মদ মাহিরেন কাছে থেকে যায় আর বাকিরা প্রতিবেশীদের খবর দিতে দৌড়ায়।
সবার সঙ্গে সুসম্পর্ক ছিল মাওলানার
মসজিদের পাশে বসবাসকারী এক ব্যক্তি আমাদের মাওলানা মুহাম্মদ মাহিরের একটি ছবি দেখাচ্ছিলেন। ছবিতে মাওলানা সাদা কুর্তা পাজামা পরিহিত, গলায় ছিল ফুলের মালা মুখে বড় দাড়ি। দেখেই বোঝা যায় শান্ত মেজাজের মানুষ ছিলেন তিনি।
নিহত মাওলানা মাহিরের চাচা আকরাম ভেজা চোখে, চাপা গলায় বলছিলেন, “কারও সঙ্গে আমাদের কোনও শত্রুতা নেই। মাওলানা সাহেব কখনো এমন কিছু জানান নি যে কেউ কোনও ধরনের হুমকি দিয়েছে বা কোনও সমস্যা তৈরি করছে। উত্তরপ্রদেশে গঙ্গার ধারে আমাদের গ্রামে খুব কম মানুষের বসবাস, খুবই সুখী গ্রাম আমাদের।“
মাওলানা মাহিরের পরিচিত শোয়েব বলছিলেন, “মাওলানা সাহেব নিজের কাজ নিয়েই থাকতেন। হিন্দু আর মুসলমান নির্বিশেষে সকলের সঙ্গে ভাল ব্যবহার করতেন। খুবই মিশুকে মানুষ ছিলেন।“
মোহাম্মদী মসজিদের দেখাশোনার দায়িত্বে থাকা আসিফ খান বিবিসিকে জানাচ্ছিলেন, "আমাদের মসজিদে তিনজন মাওলানা থেকেছেন। ওই তিনজনের মধ্যে এই মাওলানার আচরণই সবথেকে ভাল ছিল।“