সম্প্রতি ট্রান্সজেন্ডার বা রূপান্তরিত লিঙ্গের মানুষদের নিয়ে তৈরি ‘রূপান্তর’ নামের একটি নাটক ইউটিউবে প্রকাশিত হওয়ার ২৪ ঘণ্টারও কম সময়ের ব্যবধানে সরিয়ে নিয়েছে প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান।
সেইসাথে, নাটকের পৃষ্ঠপোষক ওয়ালটন ইতোমধ্যে এক ফেসবুক পোস্টে দুঃখ প্রকাশ বলেছে, নাটকের বিষয়বস্তু সম্পর্কে তাদের জানা ছিল না। যাদের সাথে নাটকের স্পন্সর করার বিষয়ে চুক্তি হয়েছিল, সেই বিজ্ঞাপনী সংস্থা ‘লোকাল বাস এন্টারটেইনমেন্ট’কে তারা আইনি নোটিশও পাঠিয়েছে।
নাটকটি ইউটিউবে প্রকাশ হওয়ার পর থেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দর্শকরা ‘ওয়ালটন’ এর পণ্য বয়কটের ডাক দেয়। অনেকে অভিযোগ করেছেন, এর মাধ্যমে 'ট্রান্সজেন্ডার প্রচারণা' করা হচ্ছে।
অপরদিকে, নাটকটি সরিয়ে নেওয়ায় অনেকে আবার সমালোচনা করছেন। তারা বলছেন, ট্রান্সজেন্ডার যেহেতু সমাজের একটি অংশ, সেটা তুলে ধরা হয়েছে।
নাটকের পরিচালক বলছেন, পুরো ঘটনায় তিনি মর্মাহত।
এই নাটকটি ঘিরে আসলে কী ঘটেছে?
কী ছিল ‘রূপান্তর’ নাটকে?
রূপান্তর নাটকটি ১৫ই এপ্রিল, সোমবার সন্ধ্যায় ইউটিউবে প্রচার করা হয়েছিলো। কিন্তু উগ্রসাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর উস্কানিতে কিছু সংখ্যক দর্শকের সমালোচনার মুখে পরদিন সকালে তা প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান একান্ন মিডিয়া’র ইউটিউব চ্যানেল থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়।
কিন্তু রাফাত মজুমদার রিংকু পরিচালিত ‘রূপান্তর’ নাটকটিকে প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান সরিয়ে নিলেও নাটকের কপি এখন বিভিন্ন ইউটিউব চ্যানেলে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে।
এখন প্রশ্ন হল, এই নাটকে কি এমন আছে যার জন্য সেটি ইউটিউব থেকে সরিয়ে নিতে হল? কেনই-বা এই ইস্যুকে ঘিরে ওয়ালটনকে জনগণের কাছে ক্ষমা চাইতে হল?
এই নাটকটি একজন চিত্রশিল্পীকে ঘিরে। গল্পে যার নাম সৌরভ। চৌরভ চরিত্রে অভিনয় করেছেন ছোট পর্দার অভিনেতা ফারহান আহমেদ জোভান।
নাটকে দেখানো হয়, ১৯৮৯ সালে নরসিংদীতে একটি ট্রেন দুর্ঘটনায় মোট ১৭০ জন মারা যান। সেসময় সৌরভের বয়স ছিল এক বছর। ভাগ্যক্রমে সেই দুর্ঘটনায় সৌরভ বেঁচে গেলেও তার মা মারা যান। সৌরভকে উদ্ধার করার পর তাকে শিশু সদনে পাঠানো হয়, সেখানেই বড় হন তিনি।
পরিবার-পরিজন ছাড়া বেড়ে ওঠা সৌরভ তার শিল্পকর্মের গুণে একসময় একজন খ্যাতিমান চিত্রশিল্পী হয়ে ওঠেন। নাটকে তাকে অনেক মানুষের পোট্রেট আঁকতে দেখা যায়।
ঘটনাক্রমে তিনি এই নাটকের আরেক চরিত্র রিমঝিমেরও পোট্রেট আঁকেন। রিমঝিম সেই পোট্রেট দেখে মুগ্ধ হন এবং তার মাঝে শিল্পীর সঙ্গে সরাসরি দেখা করার আগ্রহ জন্ম নেয়।
এক পর্যায়ে তিনি শিল্পী সৌরভকে খুঁজে বের করেন এবং তার সঙ্গে দেখা করেন। সৌরভের মেয়েদের মতো সাজপোশাক দেখে অবাক হয় রিমঝিম।
নাটকে দেখা যায়, সৌরভের বেশভূষায় থাকছে শাড়ি বা সালোয়ার কামিজ, কপালে টিপ, গলায় পুঁতির মালা, হাতে চুড়ি, নাকে নথ, কানে দুল, চোখে গাঢ় কাজল, মাথায় পরচুল, হাতে নেইলপলিশ ইত্যাদি।
সৌরভের বেশভূষা তার কাছে অস্বাভাবিক লাগলেও তিনি শেষমেষ তার প্রেমে পড়েন। এক পর্যায়ে, রিমঝিমের পক্ষ থেকে পারিবারিকভাবে বিয়ের প্রস্তাব পাঠানো হয় সৌরভের কাছে।
কিন্তু সৌরভ রিমঝিমের মাকে সরাসরি জানিয়ে দেন যে বিয়ে করা তার পক্ষে সম্ভব না। তবে রিমঝিম নাছোড়বান্দা। তিনি তার মাকে জানান যে বিয়ে করলে তিনি সৌরভকেই করবেন।
শেষে একজন চিকিৎসকের মাধ্যমে জানানো হয়, সৌরভ হরমোনজনিত এক সমস্যায় আক্রান্ত।
চিকিৎসকের ভাষায়, “সৌরভ ডিজঅর্ডার অব সেক্স ডেভেলপমেন্ট (ডিএসডি)-তে আক্রান্ত। একটি শিশুর জন্মগতভাবে জেনেটিক সেক্স থাকে, আরেকটি থাকে ফেনোটাইপিক সেক্স। এই দুইয়ের মাঝে অসামাঞ্জস্য থাকলে সেক্স প্রকাশিত হয় না।”
নাটকে চিকিৎসকের ব্যখ্যা অনুযায়ী, সৌরভ 'জেনেটিক্যালি' একজন মেয়ে। শুরুতে তার মেয়েলি হরমোন বিকশিত না হলেও, পরবর্তীতে সেটি বিকশিত হতে থাকে।
অর্থাৎ, সৌরভ দেখতে পুরুষের মতো হলেও তিনি একজন নারী।
‘রূপান্তর’ নাটকের মূল গল্প এটিই।
‘ওয়ালটন’ এর সম্পৃক্ততা যেখানে
‘রূপান্তর' নাটকটি চলাকালে সেখানে ওয়ালটন স্মার্ট ফ্রিজের বিজ্ঞাপন প্রচারিত হয়েছিল।
একান্ন মিডিয়া প্রযোজিত এই নাটকে ওয়ালটন ফ্রিজের বিজ্ঞাপন প্রচার বা ওয়ালটনের ব্র্যান্ডিং কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্ব ছিল বিজ্ঞাপনী সংস্থা ‘লোকাল বাস এন্টারটেইনমেন্ট’-এর।
কিন্তু এখন ওয়ালটন বলছে, এই নাটকের বিষয়বস্তু কোম্পানির আদর্শ ও নীতিমালার সাথে পরিপন্থী হওয়া সত্ত্বেও সেখানে ওয়ালটন ফ্রিজের বিজ্ঞাপন প্রচার করেছে সংস্থাটি।
এজন্য তারা গতকাল ওই সংস্থাকে আইনি নোটিশ পাঠিয়েছে। পাশাপাশি, প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে সব ধরনের বিজ্ঞাপনী চুক্তিও বাতিল করেছে।
নোটিশে বলা হয়েছে, “ওয়ালটন কর্তৃপক্ষকে নাটকটির বিষয়বস্তু সম্পর্কে পূর্বে অবহিত না করে রূপান্তর নাটক প্রচার করায় আপনার সঙ্গে চুক্তি বাতিল করা হলো এবং সেই সাথে কেন আপনার বিরুদ্ধে ওয়ালটনের আদর্শ ও নীতিমালার পরিপন্থিভাবে নাটক প্রচারের জন্য আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না, তা নোটিশ প্রাপ্তির সাত দিনের মধ্যে জানানোর জন্য বলা হলো।”
এ বিষয়টি সম্বন্ধে জানতে সরাসরি ওয়ালটনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে প্রতিষ্ঠানটির চিফ মার্কেটিং অফিসার দিদারুল আলম খান বলেন, “এজেন্সিকে কাজটা দেওয়া হয়েছিলো। কিন্তু এজেন্সি আসলে সিনপসিসটা (সারমর্ম) না বলে এটাকে স্পন্সরশিপে দিয়ে দিয়েছে। আমরা সেটার বিষয়ে অ্যাকশন নিয়েছি। তাদের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করেছি ও লিগ্যাল নোটিশ পাঠিয়েছি।”
এই পদক্ষেপ গ্রহণের কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আমরা ট্রান্সজেন্ডার সাপোর্ট করি না।”
এসময় তিনি জানান, নাটকের বিষয়বস্তু যদি হিজড়াদেরকে নিয়ে হতো, তাহলে তারা এরকম পদক্ষেপ গ্রহণ করতো না। “আমাদের জানালে আমরা পলিসি অনুযায়ী দেখে সিদ্ধান্ত নিতাম।”
বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটিতে পাঁচ থেকে ছয়জন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ চাকরি করছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে থার্ড জেন্ডারকে আমরা চাকরি দিতে চাই, তারা যাতে সুস্থ জীবনযাপন করতে পারে। কিন্তু ট্রান্সজেন্ডারকে আমরা সাপোর্ট করি না আসলে।''
‘রূপান্তর’ কর্তৃপক্ষ’র যা বক্তব্য
পরিচালক এই গল্পে ট্রান্সজেন্ডার বা রূপান্তরকামী মানুষদের সম্বন্ধে বলতে চাইলেও উগ্রসাম্প্রদায়িক দর্শকদের অনেকে আপত্তি তুলেছেন।
যেমন, শাফি হাসান ফেসবুকে লিখেছেন, 'এই নাটকের মধ্যেদিয়ে, শরিফ থেকে শরিফা হওয়ার গল্পটা তুলে ধরছে'। আবার রায়হান নামের একজন লিখেছেন, 'নাটকটির মাধ্যমে ট্রান্সজেন্ডার সংস্কৃতিকে প্রমোট বা প্রচার করা হয়েছে'।
আবার আসিফ ইকবাল নামের একজন ফেসবুকে লিখেছেন, 'ট্রান্সজেন্ডার, হিজড়ারা এই সমাজের অংশ। বিংশ শতকেও তাদের নিয়ে নাটক প্রচার করতে আপত্তি উঠলে তা লজ্জার'।
নাটকটির নির্মাতা রাফাত মজুমদার রিংকু বলছেন, এই পুরো ঘটনা নিয়ে ‘মর্মাহত’।
“মানসিকভাবে বিব্রত আমি। এই নাটকটি ছয় মাস আগে বানিয়েছিলাম। একজন মানুষ ন্যাচারালি-ই যদি এরকম হয়, তাদের গল্প কি বলা যাবে না? মানুষের ক্রাইসিসের গল্প কী বলা যাবে না?” তিনি প্রশ্ন করেন।
তার মতে, মানুষ ভুল বুঝে নাটকটির ভুল ব্যাখ্যা দিচ্ছেন।
এই ঘটনা সম্বন্ধে জানার জন্য প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান একান্ন মিডিয়া’র সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও কাউকে পাওয়া যায়নি।
তৃতীয় লিঙ্গ
কেউ যদি জন্মসূত্রে যে লিঙ্গ পেয়েছে, সেই পরিচয় না দিয়ে নিজেকে ভিন্ন লিঙ্গের বলে মনে করেন বা শারীরিক পরিবর্তন করেন, তাহলে তাকে ট্রান্সজেন্ডার বলা হয়।
যেমন- ট্রান্সজেন্ডার নারী এমন একজন যিনি বর্তমানে নিজেকে নারী হিসাবে পরিচয় দিলেও তিনি জন্মেছেন পুরুষ লিঙ্গ নিয়ে।
একইভাবে, ট্রান্সজেন্ডার পুরুষ এমন একজন যিনি বর্তমানে পুরুষ পরিচয় দিলেও তিনি জন্মেছেন নারীর লিঙ্গ নিয়ে। তাদের শারীরিক গড়ন নারীদের মতো হলেও আচরণে কোনো নারীসুলভ বিষয় থাকে না।
বাংলাদেশের সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ২০১৩ সালের নীতিমালা অনুযায়ী, যারা সমাজে হিজড়া বলে পরিচিত এবং নিজেকে হিজড়া বলে বর্ণনা পরিচয় দিতে অস্বত্বি বোধ করেন না, তিনি হিজড়া। বাংলাদেশে এদের তৃতীয় লিঙ্গ হিসাবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে।
তবে বাংলাদেশে ট্রান্সজেন্ডার ইস্যুতে এমন তর্ক-বিতর্ক এই প্রথম না।
চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে জাতীয় শিক্ষাক্রমের এক পাঠ্যবইয়ে থাকা ট্রান্সজেন্ডার বিষয়ক অধ্যায় নিয়ে বেসরকারি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের একজন খণ্ডকালীন সাবেক শিক্ষক আসিফ মাহতাবের বক্তব্য নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিতর্কের ঝড় উঠেছিলো।
সেসময় সামাজিক মাধ্যমে তার একটি বক্তব্য ভাইরাল হয়। সেই ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে তাকে ট্রান্সজেন্ডার এবং সমকামিতা বিরোধী বক্তব্য দিতে দেখা যায়। সেইসাথে, সেসময় তাকে সপ্তম শ্রেণির পাঠ্যবইয়ের এক অধ্যায়ে ট্রান্সজেন্ডার বিষয়ক একটি গল্পের পাতা ছিঁড়ে ফেলতেও দেখা যায়।
পরবর্তীতে ওই ঘটনার পর ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় ওই শিক্ষকের সাথে চুক্তি বাতিল করেছিল।
গত বছরের নভেম্বরে ঢাকার নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি অনুষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের একটি অংশের আপত্তির মুখে একজন ট্রান্সজেন্ডার নারীকে অংশ নিতে না দেয়ার অভিযোগ উঠেছিল।