ছবির ক্যাপশন: ১. বইয়ের প্রচ্ছদ। ২. কাল্পনিক পুনর্গঠন অনুসারে আমাদের হারিয়ে যাওয়া সহোদরেরা (বাঁ থেকে ডানে): হোমো রুডলফেনসিস (পূর্ব আফ্রিকা), হোমো ইরেক্টাস (পূর্ব এশিয়া) ও হোমো নিয়ান্ডার্থালেনসিস (ইউরোপ ও পশ্চিম এশিয়া)। এরা সবাই মানুষ।
৩. প্রায় ৩০ হাজার বছর আগে ফ্রান্সের দক্ষিণে শভে পুঁদ্যার্ক (Chauvet-Pont-d'Arc) গুহার দেওয়ালে আঁকা একটি মানুষের হাতের ছাপ। কেউ হয়তো বলতে চেয়েছিল ‘আমিও ছিলাম!
নিতান্ত সাধারণ একটি প্রাণীর গল্প
'সেপিয়েন্স মানুষের ইতিহাস' গ্রন্থ থেকে। মূল রচনা: ইউভাল নোয়া হারারি। অনুবাদ: সুফিয়ান লতিফ, শুভ্র সরকার ও রাগিব আহসান
আজ থেকে প্রায় সাড়ে ১৩০০ কোটি বছর আগে বিগ ব্যাং (Big Bang) নামে পরিচিত এক মহাবিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে সৃষ্টি হয় পদার্থের, উৎপত্তি লাভ করে শক্তি, সূচনা ঘটে সময়ের আর রচিত হয় মহাশূন্য। জ্ঞানের যে শাখা মহাবিশ্ব সম্পর্কিত এসব মৌলিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করে তাকে আমরা বলি পদার্থবিজ্ঞান। পদার্থ ও শক্তি তৈরি হওয়ার প্রায় ৩ লাখ বছর পর তারা একত্রিত হয়ে পরমাণু (Atom) নামে একটি জটিল কাঠামো গঠন করে। পরমাণু হলো মে․লের ক্ষুদ্রতম একক, যা সরাসরি রাসায়নিক পরিবর্তনে অংশ নিতে পারে। এই পরমাণুগুলো পরবর্তীতে বিভিন্নভাবে বিন্যস্ত হয়ে আরো জটিল প্রকৃতির কাঠামোর সূচনা করে, যা অণু নামে পরিচিত। পরমাণু, অণু ও তাদের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার গল্পই হলো রসায়ন।
এরও অনেক পরে, আজ থেকে প্রায় ৩৮০ কোটি বছর আগে, এই মহাবিশ্বের পৃথিবী নামক একটি গ্রহে নির্দিষ্ট কিছু অণু মিলিত হয়ে বড়ো আকারের ও আরো জটিল ধরনের বিশেষ কিছু কাঠামো গঠন করে। এদেরকে আমরা এক কথায় বলি ‘জীব’। সমস্ত জীবজগৎ ও তাদের কার্যপ্রণালি নিয়ে আলোচনা করে যে শাস্ত্র তার নাম জীববিজ্ঞান।
প্রায় ৭০ হাজার বছর আগে, সমস্ত জীবজগতের মধ্যে হোমো সেপিয়েন্স (Homo Sapiens) নামের একটি বিশেষ প্রজাতি সম্মিলিতভাবে সংস্কৃতি (Culture) নামে একটি ধারণার সূত্রপাত ঘটায়। সংক্ষেপে বলতে গেলে, কোনো একটি প্রজাতির ব্যবহৃত সব বাস্তব উপকরণ- খাদ্য, বাসস্থান, পোশাক-পরিচ্ছদ, উৎপাদন পদ্ধতি এবং আচার-আচরণকে একসঙ্গে বলা হয় তার সংস্কৃতি আর হোমো সেপিয়েন্স বা আধুনিক মানুষের সংস্কৃতির ক্রমাগত পরিবর্তনের গল্পকেই বলা হয় ইতিহাস।
তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিপ্লব ইতিহাসকে আজকের অবস্থানে এনে দিয়েছে। প্রথমটি হলো বুদ্ধিভিত্তিক বিপ্লব (Cognitive Revolution), যা প্রায় ৭০ হাজার বছর আগে মানুষের ইতিহাসের ভিত্তি স্থাপন করে। এরপর বিকাশ ঘটে কৃষিভিত্তিক বিপ্লবের (Agricultural Revolution), যা প্রায় ১২ হাজার বছর আগে মানুষের ইতিহাসকে দেয় নতুন গতি। সবশেষে, মাত্র ৫০০ বছর আগে সূচনা হয় বৈজ্ঞানিক বিপ্লবের (Scientific Revolution)। এই বিপ্লব রাতারাতি পালটে দিয়েছে ইতিহাসের গতিপথ। হয়তো একদিন বিজ্ঞানের এই বিপ্লব মানুষের ইতিহাসের ইতি টেনে সূচনা করবে সম্পূর্ণ নতুন কোনো যুগের। এই বইয়ে আমরা এই তিন বিপ্লবের প্রভাবে মানুষ ও জীবজগতের অন্যান্য সদস্যদের পালটে যাওয়ার গল্পটাই জানার চেষ্টা করব।
বুদ্ধিভিত্তিক বিপ্লবের অনেক আগে থেকেই অর্থাৎ ইতিহাসের সূচনার বহু আগে থেকেই পৃথিবীতে মানুষের বিচরণ ছিল। আধুনিক মানুষের মতো বুদ্ধিমান প্রাণীর প্রথম আবির্ভাব ঘটে প্রায় ২৫ লাখ বছর আগে। এর আগে হাজার হাজার প্রজন্ম ধরে মানুষের পূর্বপুরুষেরা অন্য দশটা সাধারণ প্রাণীর মতোই জীবন যাপন করে এসেছে। তাদের ছিল না হাতির মতো বিশাল আকার-আকৃতি, আলাদা করে চেনার মতো প্রখর বুদ্ধিমত্তা কিংবা খাদ্যশৃঙ্খলে একক কোনো আধিপত্য।
২০ লাখ বছর আগের পূর্ব আফ্রিকার কোনো গ্রামে হাঁটতে বেরোলে মানুষের চরিত্রের চিরচেনা রূপটাই হয়তো আপনার চোখে পড়ত। আপনি দেখতেন ছোটো বাচ্চাদের বুকে আগলে রাখা উদ্বিগ্ন মাকে আর কাছেপিঠেই খেলাধুলায় মেতে থাকা ছোটো ছেলেমেয়েদের। দেখতে পেতেন সমাজের নিয়মভাঙা সাহসী তরুণদের কিংবা এমন সব বুড়োদের, যারা বাকি জীবনটা কোনোরকমে শান্তিতে কাটাতে পারলেই খুশি। হয়তো দেখতেন শারীরিক শক্তি বা বীরত্ব প্রদর্শনের মাধ্যমে সুন্দরী নারীর মন ভোলাতে ব্যস্ত কিছু যুবককে আর জীবনভর এই সবকিছু দেখে আসা
কোনো সবজান্তা, অশীতিপর বৃদ্ধাকেও। এই প্রাচীন মানুষেরা ভালোবেসেছে, খেলাধুলা করেছে, গভীর বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে এবং সমাজে গুরুত্বপূর্ণ ও শক্তিশালী হওয়ার জন্য প্রতিযোগিতায় নেমেছে। একই কাজ করেছে শিম্পাঞ্জি, বেবুন ও হাতিও। মানুষ তখন কোনোভাবেই প্রাণিকুলের অন্যদের থেকে গুরুত্বপূর্ণ কিছু ছিল না। এ রকম কোনো লক্ষণই তখন তাদের মধ্যে দেখা যায়নি, যেটা দেখে কেউ অনুমান করতে পারবে যে তাদেরই সুদূর বংশধরেরা একদিন চাঁদের বুকে হাঁটবে, পরমাণুকে দ্বিখণ্ডিত করবে, ডিএনএর রহস্য উন্মোচন করবে অথবা ইতিহাসের বই লিখবে। সুতরাং, প্রাগৈতিহাসিক মানুষ সম্পর্কে জানার সময় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি খেয়াল রাখতে হবে তা হলো, তখন মানুষ খুবই গুরুত্বহীন একটা প্রাণী ছিল। বনমানুষ, মাছি বা পেঙ্গুইনের থেকে পৃথিবীর ওপর বেশি প্রভাব মানুষের ছিল না। প্রাগৈতিহাসিক মানুষের ইতিহাস তাই প্রাণিবিদ্যা বইয়ের সাধারণ একটি অধ্যায় ছাড়া আর কিছুই নয়।
জীববিজ্ঞানীরা জীবজগৎকে বিভিন্ন প্রজাতিতে বিভক্ত করেছেন। দুটি প্রাণী মিলনের মাধ্যমে যদি সফলভাবে বংশধর তৈরি করতে সক্ষম হয়, তবে তাদেরকে একই প্রজাতির অন্তর্ভুক্ত বলে ধরা হয়। দুটো উদাহরণ থেকে আমরা বিষয়টি আরেকটু সহজভাবে বোঝার চেষ্টা করতে পারি। আমরা জানি, বিবর্তনের পরম্পরায় একই পূর্বপুরুষ থেকে গাধা ও ঘোড়ার উৎপত্তি হয়েছে এবং সে কারণেই তাদের শারীরবৃত্তীয় বৈশিষ্ট্যের মধ্যে যথেষ্ট মিল লক্ষ করা যায়। কিন্তু, তারা একে অপরের প্রতি খুব কমই যৌন আকর্ষণ বোধ করে। মানুষ চেষ্টা করলে তাদের মধ্যে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করাতে পারে, কিন্তু সেক্ষেত্রে তাদের মিলনের ফলে উৎপাদিত সন্তান হয় বন্ধ্যা, সন্তান উৎপাদনে অক্ষম। এদেরকে আমরা ‘খচ্চর’ নামে চিনি। উৎপাদিত সন্তান বন্ধ্যা হওয়ার কারণ হলো, গাধার রূপান্তরিত ডিএনএ কখনোই ঘোড়ার ডিএনএর সঙ্গে ভালোভাবে খাপ খায় না, ঘোড়ার ডিএনএর ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। এ কারণে গাধা ও ঘোড়া একই পূর্বপুরুষ থেকে বিবর্তিত হলেও তারা দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রজাতি, বিবর্তনের সম্পূর্ণ ভিন্ন পথে তাদের দুজনের যাত্রা।
অন্যদিকে বুলডগ ও স্প্যানিয়েল দেখতে সম্পূর্ণ আলাদা বলে তাদেরকে ভিন্ন প্রজাতির মনে হলেও আসলে তারা কিন্তু একই প্রজাতির সদস্য। কারণ, তারা দুজনেই একই রকম ডিএনএ বহন করছে। তারা খুব স্বাভাবিকভাবেই যৌনক্রিয়ায় আবদ্ধ হতে পারবে, তাদের খুব সুন্দর বাচ্চা হবে এবং সেই বাচ্চারাও পরিণত বয়সে অনেক বাচ্চার জন্ম দিতে পারবে।
যেসব প্রজাতি একই পূর্বপুরুষ থেকে এসেছে তাদেরকে একই ‘গণ’ বা ‘জাতি’র (Genus, বহুবচন Genera) অন্তর্ভুক্ত বলে ধরা হয়। সিংহ, বাঘ, চিতা ও জাগুয়ার- এরা প্রত্যেকেই প্যানথেরা (Panthera) নামক জাতের আলাদা আলাদা প্রজাতি। জীববিজ্ঞানীরা প্রাণীদের নামকরণ করেন দুটি পৃথক ল্যাটিন শব্দের মাধ্যমে। আগে গণ বা জাতির নাম, পরে প্রজাতির নাম। যেমন, সিংহের নাম প্যানথেরা লিও (Panthera Leo) যার অর্থ প্যানথেরা শ্রেণির সিংহ প্রজাতি। ধরে নেওয়া যায়, এ বই যারা পড়বে তাদের প্রত্যেকেই হোমো সেপিয়েন্স (Homo sapiens) অর্থাৎ মানুষ (Homo অর্থ মানুষ) শ্রেণির জ্ঞানী (Sapiens অর্থ জ্ঞানী) প্রজাতির।
কয়েকটি ‘গণ’ আবার একটি ‘পরিবার’ (family) তৈরি করে। যেমন- সিংহ, চিতা বাঘ, পোষা বিড়াল- এরা বিড়াল পরিবারভুক্ত; নেকড়ে, খ্যাঁকশিয়াল এবং শেয়াল- এরা কুকুর পরিবারের সদস্য এবং হাতি, ম্যামথ, মাসটোডোন- এরা হাতি পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। একই পরিবারের সমস্ত সদস্য অতীতের কোনো পিতৃতান্ত্রিক বা মাতৃতান্ত্রিক গোষ্ঠী থেকে বিকাশ লাভ করেছে বা বিবর্তিত হয়েছে। গৃহস্তের আদরের পোষা বিড়াল এবং বনের হিংস্র বাঘ আসলে একই পূর্বপুরুষ থেকে উদ্ভূত, প্রায় আড়াই কোটি বছর আগে পৃথিবীতে ছিল যাদের বসবাস।
জীবজগতের অন্য প্রাণীদের মতো মানুষও অনেকগুলো গণ বা জাতি নিয়ে গঠিত একটি পরিবারের অংশ। আশ্চর্যজনকভাবে, এই নিতান্ত সাধারণ ব্যাপারটিকে অদ্ভুত কারণে মানুষ বারবার গোপন করতে চেয়েছে। ‘হোমো সেপিয়েন্স’ নামের এই প্রাণীটি বরাবরই নিজেদেরকে বাকি প্রাণিজগৎ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা করে দেখতে চায়, দেখে এসেছে। ভাবখানা এমন, যেন তারা অনাথ একটা প্রজাতি, তারা কোনো পরিবারের অংশ নয়, তাদের কোনো ভাইবোন নেই, এমনকি পিতা-মাতা বা অন্য কোনো পূর্বপুরুষও নেই। তা কিন্তু একেবারেই সত্য নয়। পছন্দ করুন আর না-ই করুন, আমরা গ্রেট এপ (Great Ape) নামের বিশাল জনবহুল এক পরিবারের অংশ। আমাদের পরিবারের জীবিত নিকটাত্মীয়দের মধ্যে শিম্পাঞ্জি, গরিলা ও ওরাং-ওটাং উল্লেখযোগ্য। এর মধ্যে শিম্পাঞ্জিরা আমাদের সবচেয়ে কাছের আত্মীয়। প্রায় ৬০ লাখ বছর আগে এক নরবানর (Ape) মায়ের দুটি কন্যাসন্তান ছিল। এদের একজন সমস্ত শিম্পাঞ্জির আদিমাতা এবং অন্যজন হলো আধুনিক মানুষের প্রাচীনতম নানি।