বিশ্ব নন্দিত অর্থনীতিবিদ ও দার্শনিক কার্ল মার্ক্স-এর ২০৬তম জন্মদিনের শুভেচ্ছা। ১৮১৮ সালে ৫ই মে, এই সমাজতান্ত্রীক অর্থনীতির স্রষ্টা জার্মানির ট্রিয়ার শহরে জন্মগ্রহণ করেন। শ্রমিক আন্দোলনের আর এক পুরোধা ফ্রেডরিক এঙ্গেলস-এর সাথে যুক্ত হয়ে পুরো আন্দোলনের আদর্শিক নেতৃত্ব দিয়েছেন এই জার্মান দার্শনিক, অর্থনীতিবিদ, ইতিহাসবিদ, সমাজবিজ্ঞানী, রাজনৈতিক তাত্ত্বিক, সাংবাদিক এবং সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবী।
তাঁর জীবনের ছোট্ট কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় তুলে ধরছি। ১৮৩০ এর দশকে বার্লিন কীভাবে তরুণ কার্ল মার্ক্সকে আকৃষ্ট করেছিল সেটা নিয়েই এই প্রতিবেদন:
কার্ল মার্কস তাঁর যৌবনের পাঁচটি বছর বার্লিনে বসবাস করে ছিলেন (১৮৩৬ থেকে ১৮৪১)। এখানেই তিনি আইন পড়াশোনা বাদ দিয়ে দর্শনে ভর্তি হন, যেজন্যে তাঁর বাবা হাইনরিখ মার্কস খুব মনখারাপ করেন, কারণ কার্ল আইন পেশায় গেলে পরিবারের সন্মান অক্ষুণ্ণ রাখতেন- এটাই সকলে ভেবেছিলেন, কিন্তু দর্শন শাস্ত্রে ভবিষ্যৎ অন্ধকার দেখেছেন তার বাবা। বার্লিনে এসে তিনি শ্রমিকদের দুর্দশার বিষয়টি জানতে পারেন।
ছেলেটি কয়েক সপ্তাহ ধরে উত্তর দেয়নি বাবার চিঠির। 'আমি প্রত্যাশা করি'- অবশেষে রাগান্বিত বাবা লিখেছেন যে, তুমি 'সাথে সাথে মাকে শান্ত করো'। হাইনরিখ মার্ক্স কেবল তখনই সবচেয়ে সেরাটি চেয়েছিলেন যেমন প্রতিটি বাবা চায়, যখন তিনি তার ছেলেকে বন-বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়েছিলেন - তাঁর নিজের উকিল হওয়া উচিত। আর ছেলেটা কী করে, সেখানে আইন পড়া বাদ দিয়ে বার্লিনে দর্শন পড়তে যায়?
ঘোড়ার গাড়ির পোস্টকোচে চড়ে পাঁচ দিন যাত্রার পরে- মার্কস ১৮৩৬ সালের অক্টোবরের মাঝামাঝি বার্লিনে পৌঁছেছিলেন। প্রায় পাঁচ বছর ধরে, ১৮৪১ সালের মে মাস পর্যন্ত তিনি এই শহরেই থাকেন, এখানে দর্শনের লেখাপড়া চলে এবং শেষপর্যন্ত তাঁর ডক্টরাল থিসিস লিখেছেন, এবং বার্লিনে তিনি বেশ কয়েকবার, প্রায় প্রতিটি সেমিস্টারে নতুন ছাত্রাবাসে চলে আসেন, যা তখনকার শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রচলিত ছিল। সব মিলিয়ে কার্ল মার্ক্সের ছাত্রাবাস ও বাসা মিলিয়ে সাতটি ঠিকানা পাওয়া যায় বার্লিনে, যদিও বাড়ির সংখ্যা সেসময় আজকের তুলনায় খুব কমই ছিলো, অবশ্য লোকজন ও কম ছিলো।
এভাবেই ১৮ বছর বয়সী কার্ল মার্কস তাঁর যাত্রা শুরু করেছিলেন বার্লিনে- এবং এটি কোনও আইনজীবী হিসেবে নয় বরং দর্শন ও অর্থনীতিবিদ হিসেবে। এরই মধ্যে তার শৈশবের বান্ধবী জেনি'র সাথে পরিচয়টা আরো গাঢ় হয় চিঠির যোগাযোগের মাধ্যমে।
জেনি তার জীবনের দুর্দান্ত প্রেম ছিল। জেনি ভন ওয়েস্টফালেন একজন সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়ে ছিলেন, তিনি পুরানো শহরে সালসওয়েডেলে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং ট্রিয়াতেই বেড়ে ওঠেন: তার বাবা একজন উদার অভিজাত ছিলেন, তাঁর মা মধ্যবিত্ত থেকে এসেছিলেন। জেনি শিক্ষিত, দার্শনিক পাঠ্য পড়তেন, ইংরেজি এবং গ্রীক শিখতেন। পরিবারটি ট্রিয়াতে সামাজিক জীবনে অংশ নিয়েছিল এবং সুন্দরী জেনি একসময় পরিবারের আদরেই ছিলেন। জেনির চেয়ে চার বছরের ছোট কার্লের সাথে শৈশবের পরিচয় থেকে ভালোবাসা এবং অবশেষে প্রণয়ে আবদ্ধ হলেন দুজনের ১৮৪৩ সালে।
তারা গোপনে প্রেমে জড়িয়ে পড়েন। এটি ১৮৩৬ সালে এবং যদিও জেনির বাবা কার্লের সাথে সম্পর্কের বিরুদ্ধে ছিলেন, তাই তাঁর মৃত্যুর পরই দুজন বিয়ে করেছিলেন। কার্ল তার সুন্দরী স্ত্রীর জাঁকজমকপূর্ণ সোনালি চুল পছন্দ করতেন। এই দম্পতির সাতটি সন্তান ছিল; তিন কন্যা প্রাপ্তবয়স্কতায় পৌঁছেছিল বাঁকিরা কিশোর বয়সেই মারা যায়: জেনি, লরা এবং এলেনোর এই তিন কন্যাই কার্ল মার্ক্সের শেষদিকেও বেঁচে ছিলেন।
হেগেলের দর্শনের সমালোচনা (Kritik an Hegels Philosophie) ১৮৪৪ সালে জার্মান রাজনৈতিক দার্শনিক কার্ল মার্ক্সের লেখা একটি পাণ্ডুলিপি।
তাঁর জীবদ্দশায় অপ্রকাশিত, এটি একটি পাণ্ডুলিপি যেখানে মার্কস তাঁর দার্শনিক জর্জ উইলহেলম ফ্রেডরিখ হেগেলের ১৮২০ সালের 'এলিমেন্টস অফ দ্য ফিলোসফি অব রাইট' অনুচ্ছেদে ডক্টর থিসিস এর একাংশ লিখেছিলেন। দলিলটিতে হেগলের উপর মার্কসের অন্যতম প্রধান সমালোচনা হ'ল তাঁর বহু দ্বান্দ্বিক যুক্তি বিমূর্ততায় শুরু হয়।
এই কাজটিতে মার্কসের বিশেষ বিচ্ছিন্নতা তত্ত্বের সূত্র রয়েছে, যা লুডভিগ ফেয়ারবাখের কাজ দ্বারা অবহিত করা হয়েছিল। রচনার বর্ণনার সূচনায় ধর্মের কার্যকারিতা নিয়ে মার্কসের সর্বাধিক বিখ্যাত ভাষ্যসহ সুশীল সমাজ এবং রাজনৈতিক সমাজের মধ্যে সম্পর্কের বিশ্লেষণের চারদিকে বিকাশ ঘটে।
মার্কসবাদ: ঊনবিংশ শতাব্দীর দার্শনিক, অর্থনীতিবিদ, সাংবাদিক এবং বিপ্লবী কার্ল মার্কস ও ফ্রিডরিখ এঙ্গেলসের তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা রাজনৈতিক অনুশীলন ও সামাজিক তত্ত্ব। এই তত্ত্বে সামাজিক পরিবর্তনের দ্বান্দ্বিক ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদী দৃষ্টিতে সামাজিক দ্বন্দ্ব ও শ্রেণি-সম্পর্ককে ভিত্তি করে সমাজ বিশ্লেষণের বিশ্বদর্শন ও প্রক্রিয়া বয়ান করা হয়েছে। মার্কসবাদী প্রক্রিয়াকে পদ্ধতিগত অর্থনৈতিক পরিবর্তনে শ্রেণিসংগ্রামের ভূমিকা এবং পুঁজিবাদের বিকাশের সমালোচনা ও বিশ্লেষণে অর্থনৈতিক ও সামজিক-রাজনৈতিক জিজ্ঞাসা ও প্রয়োগে ব্যবহার করা হয়।
মার্কসবাদের মূল দর্শন: উৎপাদন ব্যবস্থা বা অর্থনৈতিক ব্যবস্থা হলো ভিত্তি, আর ভিত্তির উপর নির্ভর করে গড়ে ওঠা সাংস্কৃতিক ব্যবস্থা হলো উপরিকাঠামো। মার্কসবাদী রাজনীতি অনুসারে, আগে ভিত্তি, পরে উপরিকাঠামো; আগে অর্থনীতি, পরে সংস্কৃতি। মানুষের জীবন চর্চার ক্ষেত্রে ভিত্তিটাই হলো প্রাথমিক বা মুখ্য উপাদান, আর উপরিকাঠামো হলো গৌণ বা কম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। অবশ্য এখানে উল্লেখ্য যে, ভিত্তি-উপরিকাঠামোর সম্পর্কটা যান্ত্রিক নয়, পরন্তু দ্বান্দ্বিক। অর্থাৎ ভিত্তি উপরিকাঠামোকে গড়ে তোলে, আবার উপরিকাঠামোও ভিত্তির উপর ক্রিয়া করে- এরা পরস্পরকে যুগপৎ দ্বান্দ্বিকভাবে প্রভাবিত করে।
দার্শনিক হেগেলের মতে, মানব চেতনার মুক্তিই ইতিহাসের অভীষ্ট লক্ষ্য। হেগেল মনে করেন, যখন আমরা সবাই উপলব্ধি করতে পারব যে, আমরা বিশ্বজনীন মানবসত্তার একেকটি অংশ, তখনই সেই লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব হবে। কার্ল মার্ক্স হেগেলের ‘আদর্শিক’ ব্যাখ্যাটিকে এমন একটি ‘বস্তুগত’ আদর্শে রূপান্তরিত করেছেন, যে আদর্শে আমাদের জাগতিক বস্তুগত অভাব মেটানোর সন্তুষ্টিই ইতিহাসের চালিকাশক্তি হিসেবে গণ্য করা হয় এবং যে আদর্শে একমাত্র শ্রেণিসংগ্রামকেই মুক্তি অর্জনের পথ মনে করা হয়।
১৯৯০ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন সহ পূর্ব-ইউরোপের দেশগুলি থেকে কমিউনিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থার বিলুপ্তি হলেও মার্ক্সবাদের অবসান হয়নি এখনো।
কার্ল মার্ক্সের জীবনের সংক্ষিপ্ত ঘটনাপঞ্জি:
মার্ক্সবাদী আদর্শের প্রবক্তা ও শ্রমিক শ্রেনীর আধ্যাত্মিক নেতা কার্ল মার্ক্সের স্ত্রী ছিলেন একজন ফিউডেল জমিদার বংশের কন্যা জেনি ফন ওয়েস্টফালেন, (কার্ল-এর চেয়ে ৩ বছরের বড় ছিলেন জেনি) উত্তর জার্মানির ছোট্ট সালসভেডেল শহরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন একটি সাম্প্রতিকতম ফিউডেল পরিবারে, আভিজাত্যে ছোটবেলায় কাটান তিনি।
কার্ল মার্ক্স উনিশ শতকের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক এবং আজ অবধি অন্যতম বিখ্যাত জার্মান অর্থনীতিবীদ। তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৮১৮ সালের ৫ মে, ট্রিয়ার আইনজীবি হাইনরিখ এবং হেনরিয়েটা মার্ক্সের তৃতীয় সন্তান।
১৮৩৩ সাল থেকে তিনি বন এবং বার্লিনে আইন বিষয়ে পড়াশোনা করেন। বার্লিনে তিনি বাম আদর্শের হেগেলিয়ানদের একদল ডক্টরক্লাবকে ঘন ঘন আত্মসাহস জুগিয়েছিলেন। এই প্রভাবের অধীনে তিনি ইতিহাস এবং দর্শনের সাথে ক্রমশ একত্র হয়ে পড়েন। ১৯৪১ সালে তিনি 'গণতান্ত্রিক এবং এপিকিউরিয়ান প্রাকৃতিক দর্শনের মধ্যে পার্থক্য' বিষয় নিয়ে ইয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শনে ডক্টরেট লাভ করেন। তার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের কারণে তিনি প্রুশিয়ায় একাডেমিক কেরিয়ার থেকে বঞ্চিত হন।
১৮৪২ সালের অক্টোবরে কার্ল মার্কস কোলোনে 'রাইনিশে সাইতুং ফর পলিটিক, হ্যান্ডেল আন্ড বিজনেস' -এর প্রধান-সম্পাদক হন, যা বিভিন্ন বিরোধী স্রোতকে একত্র করে দেয়। রাইনল্যান্ডে রাজনৈতিক ও সামাজিক ইস্যুতে রেডিকেল ডিক্যাল সমালোচনামূলক নিবন্ধের কারণে, পত্রিকাটি ১৮ মার্চ, ১৮৪৩ সালে প্রুশিয়ান সরকার নিষিদ্ধ করেছিল। তারপর মার্ক্স প্যারিসে চলে যান।
সেই থেকেই কার্ল মার্ক্স দেশান্তরি হন, প্রারিস থেকে ব্রাসেলস, তারপর লন্ডন, সেখানেই তাঁর শেষ জীবন কাটে ও মৃত্যুবরণ করেন।
প্যারিসে তিনি ফরাসি শ্রমিক আন্দোলনের নেতাদের সাথে এবং লিগ অফ জাস্টিজ ও প্যারিস কমিউন সদস্যদের সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ স্থাপন করেছিলেন। প্যারিসে আশ্রয় প্রাপ্ত জার্মানদের সাথেও তার সুসম্পর্ক ছিল। ১৯৪৪ সালের অগস্টের শেষে, ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস ইংল্যান্ড থেকে জার্মানি যাওয়ার পথে প্যারিসে পৌঁছেছিলেন। দুজনের মধ্যে ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। প্রথম যৌথ প্রকাশনী শুরু হয়।
ফ্রেডকিখ এঞ্জেলস এর সাথে কার্ল মার্ক্সের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের ফলেই মার্ক্সবাদের শ্রমিক শ্রেণির আন্দোলন গড়ে ওঠে। ১৮৬৭ সালে তাঁর বিখ্যাত বই 'ড্যাস ক্যাপিটাল' প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হয় লন্ডন থেকে।
ছবি: জেনি ও কার্ল, এঙ্গেলস ও মার্কস
ভিডিওটি দেখতে পারেন: