আরব ভূমির আবহাওয়া ও জল-বায়ু এমন যে, সেখানে দ্বন্দ্ব-সংঘাত-হানাহানি লেগেই থাকে। ইতিহাস থেকে জানা যায়, বাণিজ্য কাফেলা আক্রমণ, কাবাঘর দখল, গোত্রে গোত্রে হানাহানি। মুসলিমদের গোত্রের পর গোত্র উৎখাত করে দখল করে নেয়া। মক্কা দখল, এরপর মুসলিম শাসকদের যুদ্ধ ও নৃশংসতার চিত্র ভয়াবহ। সেই তুলনায় মাবতাবাদী বিশ্বের চাপে হলেও কিছুটা সংযত তো থাকতেই হয়। তারপরও আড়ালের ঘটনা যখন প্রকাশ্যে আসে তখন শিউরে উঠতেই হয়। মোহাম্মদ বিন সালমানের উচ্চাভিলাষী শাসন ভাবনা প্রায়ই প্রকাশিত হয়। আর এটা প্রকাশ যারা করে দেন, তাদের পরিণতিও নৃশংস হত্যার মধ্য দিয়েই হয়ে থাকে। সাংবাদিক জামাল খাশাগী তার উদাহরণ। সংবাদটা দেখি তাহলে:
নিজের প্রয়োজনে কতটা ভয়ংকর হতে পারেন সৌদি যুবরাজ ও ডি-ফ্যাক্টো শাসক মোহাম্মদ বিন সালমান, তার আরেকটি প্রমাণ উন্মোচিত হলো বিশ্ববাসীর সামনে। তার নিষ্ঠুরতার মাত্রা জানতে পেরে হতবিহবল হয়ে পড়েছেন অনেকেই। সম্প্রতি এমবিএসের ভয়ংকর এই চেহারা ফাঁস করে দিয়েছেন সৌদি আরবেরই সাবেক এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা।
মোহাম্মদ বিন সালমানের উচ্চাভিলাষী প্রকল্পের নাম নিওম। ১৭০ কিলোমিটার দীর্ঘ এই প্রকল্পটি দ্য লাইন নামেও পরিচিত। এটি বাস্তবায়নের পথে কেউ বাধা হয়ে দাঁড়ালে তাকে মেরে ফেলার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল সৌদি আরবের নিরাপত্তা বাহিনীকে। আর এই ক্ষমতা দিয়েছিলেন স্বয়ং এমবিএস নিজে। সম্প্রতি ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ওই গোয়েন্দা কর্মকর্তা এ তথ্য জানিয়েছেন।
কর্নেল রাবিহ আলেনেজি নামে সৌদি আরবের ওই কর্মকর্তা জানিয়েছেন, দ্য লাইন বা নিওম প্রকল্পের জমি গ্রহণের জন্য কেউ বাধা হয়ে দাঁড়ালে প্রয়োজনে তাকে মেরে ফেলার নির্দেশ ছিল। এই নির্দেশের পর একজন গ্রামবাসীকে গুলি করে হত্যাও করা হয়েছে।
কর্নেল আলেনেজি গত বছর যুক্তরাজ্যে নির্বাসনে চলে যান। মূলত সেখানে থাকার কারণেই তিনি এ কথা প্রকাশ করতে পেরেছেন। এই গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানান, দ্য লাইন থেকে সাড়ে ৪ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত একটি গ্রাম আল-খুরাইবাহের বাসিন্দাদের সেখান থেকে চলে যেতে বলা হয়। এই গ্রামটির বাসিন্দারা হুওয়াইতাত গোত্রের সদস্য।
আলেনেজি জানান, ২০২০ সালের এপ্রিল মাসের এক আদেশে বলা হয়েছিল, হুওয়াইতাত গোত্রটি বিদ্রোহীদের নিয়ে গঠিত এবং যদি কেউ দ্য লাইনের জন্য জমি অধিগ্রহণের বিরোধিতা করে, তাহলে তাকে হত্যা করতে হবে। তিনি বলেন, এটি মূলত জমি অধিগ্রহণের জন্য মানুষ মারার ছাড়পত্র ছিল। তবে আলেনেজি শারীরিক অসুস্থতার অজুহাত দিয়ে নিজে সেই মিশনে অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত থাকেন।
সৌদি আরবের সাবেক এই গোয়েন্দা কর্মকর্তার দেওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে জানা যায়, দ্য লাইন প্রকল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণের বিরোধিতা করা থেকে বাধা দেন আব্দুল রহিম আল-হুওয়াইতি নামের এক ব্যক্তি। তার একদিন পরই তাকে গুলি করে হত্যা করা হয় এবং গ্রামটি উচ্ছেদ করা হয়। এই ঘটনায় সৌদি নিরাপত্তা বাহিনীর বিবৃতিতে বলা হয়, হুওয়াইতি গোত্রটি নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর গুলি ছুড়লে জবাবে তারাও পাল্টা গুলি করে। আর সেই গুলিতেই মারা যান আব্দুল রহিম।
সাংবাদিক জামাল খাশোগিকে হত্যার অনুমোদন দিয়েছিলেন যুবরাজ সালমান
মার্কিন গোয়েন্দা তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালে সৌদি সাংবাদিক জামাল খাশোগিকে হত্যার অনুমোদন দিয়েছিলেন যুবরাজ সালমান। যুক্তরাষ্ট্রে সাংবাদিক জামাল খাশোগি হত্যাকাণ্ড নিয়ে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইন্টেলিজেন্সের পরিচালকের দপ্তরের চার পাতার ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘সৌদি আরবের যুবরাজ মুহাম্মদ বিন সালমান সাংবাদিক জামাল খাশোগিকে হত্যা বা আটক করতে তুরস্কের ইস্তাম্বুলে অভিযানের অনুমোদন দিয়েছিলেন বলে আমাদের কাছে প্রতীয়মান হয়েছে।’
২০১৮ সালের অক্টোবরে তুরস্কের ইস্তাম্বুলের সৌদি দূতাবাসে যাওয়ার পরই নিখোঁজ হন ওয়াশিংটন পোস্টের কলামিস্ট সৌদি সাংবাদিক জামাল খাশোগি। সৌদি রাজবংশের ক্ষমতাধরদের কড়া সমালোচনার জন্য আলোচিত ছিলেন সুপরিচিত এই সাংবাদিক।
পুলিশের ধারণা, ৫৯ বছর বয়সী সাংবাদিক খাশোগিকে শ্বাসরোধ করে হত্যার পর তার মরদেহ টুকরো করে পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। সৌদি সরকার বরাবরই এ হত্যাকাণ্ডে যুবরাজের সংশ্লিষ্টতা থাকার বিষয়টি অস্বীকার করেছে।
শুক্রবার মার্কিন বিবৃতি প্রকাশের পর তাদের তদন্ত প্রত্যাখ্যান করেছে সৌদি আরব। সৌদি সরকার আগের বিবৃতির মতো আবারও জানিয়েছে, খাশোগির হত্যাকাণ্ড একদল দুর্বৃত্তের জঘন্য অপরাধ ছিল।
২০১৮ সালেও সৌদির যুবরাজই এই হত্যাকাণ্ডের নির্দেশদাতা বলে সিআইএ সন্দেহ করেছিল। তবে এর আগে যুক্তরাষ্ট্র কখনো বিষয়টি প্রকাশ করেনি।