মাত্র ১১ বছরের ব্যবধান। সেদিন গণজাগরণ মঞ্চে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের বিশাল একটা ছবি এঁনে রেখেছিল তরুণরা। গণকন্ঠে গেয়েছিল ‘আমার সোনার বাংলা’। আজ ১১ বছর পর সেই একই শাহবাগে নতুন প্রজন্মের তরুণরা। সেখানে প্রধান শ্লোগান ছিল ‘ভুয়া ভুয়া’। তারা ভাস্কর্য ভেঙেছে। গণভাবন লুট করেছে। লুটকে বৈধ করেছে। নিজেরা প্রকাশ্যে বলেছে, এগুলো হচ্ছে গণিমতের মাল! দেশে ১১ বছর ধরে সরকারী প্রণোদনায় গণিমতের মালের ওয়াজ আর জুম্মার বাম্পার ফল হয়েছিল। তারা শাহবাগে আন্দোলনের সময় রাস্তায় নামাজ পড়েছিল। এরা মঙ্গল প্রদীপকে নিশ্চিত করেই হারাম মনে করবে। কারণ তাদের হিরো এখন আজহারী-মামুনুল হক। তাদের বুদ্ধি সলিমুল্লাহ খান, আসিফ নজরুল। তাদের সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব শহিদুল হক। দেশের স্থাপতি থেকে বীরশ্রেষ্ঠদের ভাস্কর্য সবগুলো ভেঙেছে। জাহানারা ইমামের ভাস্কর্য থাকলে সেটাও আজ ভেঙে গুড়িয়ে দিত।
গণজাগরণ মঞ্চের তরুণদের শেখ হাসিনা এক পর্যায়ে নিজের ক্ষমতার জন্য ভবিষ্যতের প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করে এটাকে ছত্রভঙ্গ করলেন ঘুষ দিয়ে, লাঠি পিটিয়ে, দালালীর মাধ্যমে। শেষ হয়ে গেলে প্রগতিশীল সেক্যুলার মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় জাগ্রত একটা ভাবী রাজনৈতিক শক্তির সম্ভাবনা। ২০২৪ সালের সেই শূন্যতায়, ১১ বছরের হেফাজতী তোষামদে যে ইসলামি সমাজ গড়ে উঠেছিল শেখ হাসিনার শাসনে- সেখানে বেড়ে উঠল এমন প্রজন্ম যাদের প্রিয় কবি আল মাহমুদ। আল মাহমুদ বড় কবি বা তার কাব্য রসের কারণে নয়, আল মাহমুদ বখতিয়ারের ঘোড়া কবিতা লিখেছিলেন বলে। জাহানারা ইমামকে তারা চেনে না। কিভাবে চিনবে বলেন? সরকার কি জাহানারা ইমামকে চিনিয়েছে প্রজন্মকে? যদি জানাহারা ইমামকে চিনিয়ে নেত্রীর চেয়ে বড় হয়ে উঠে এই তো ভয়! তাজউদ্দীনকে যেভাবে হাইড করা হয়।
আফগানিস্থানে নজিবুল্লাহ সরকার আফগানিস্থানের শহরে শিক্ষিত ও ধনীর শ্রেণীর মধ্যে আধুনিক পাশ্চত্য শিক্ষা সংস্কৃতি ছড়িয়ে দিলেও গ্রাম ও পার্বত্য অঞ্চল জুড়ে কওমি মাদ্রাসার বিস্তার নিয়ে ছিল উদাসিন। ফলে নজিবুল্লার পতনের পর আফগানের ধনীরা বিমানের চাকা ধরেও পালিয়েছিল নারকীয় শাসন থেকে বাঁচতে। এখন যারা আধুনিক জীবন-যাপনের মানুষ দেশ স্বাধীন করলো তারা বিমানের চাকা ধরেও পালাতে পারবে কিনা ভবিষ্যতেই বলে দিবে। যেভাবে তারা মূর্তি ভাস্কর্য ভেঙেছে, তাতে ক্ষমতা কাদের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে বুঝা গেছে। হিন্দুদের উপর হামলাগুলো গণমাধ্যম ব্লাকআউট করে রেখেছে। নাহলে নতুন মুক্তিযুদ্ধের সৈনিকদের কুকর্ম ধরা পড়ে যাবে। মামুনুল হক আর জামাত আমির যে যুদ্ধের পর স্বাধীনতার প্রথম দিনে বঙ্গভবনে গিয়ে চা-নাস্তা খেয়ে আসে, সেই স্বাধীন দেশে জিন্স ফতুয়া পরা শ্লোগান-কন্যারা কেমন থাকেন- দেখার আশায় রইলাম।
ছাত্র আন্দোলনের শুরুতে বলেছিলাম, যে কোন আদর্শের জন্যও একটি হত্যা, একটি মানুষের মৃত্যু সমর্থন করা যায় না। যত মহানই হোক সে আদর্শ। তখন সরকার সমর্থকরা হত্যার পক্ষে ছিলেন। কটুক্তি করেছিলেন আমাকে। এখন কথিত ‘নতুন প্রজন্মের মুক্তিযোদ্ধাদের’ চালানো হত্যা, লুটপাট, অগ্নিসংযোগকে সমর্থক করে মহান বিপ্লবীরা বলছেন, এইসব ছোটখাটো জিনিস সামনে এনে আমাদের মহান বিপ্লবকে বিতর্তিক করা যাবে না!
এই কারণই দু'পক্ষের কারোর সঙ্গেই আমি ছিলাম না। আজো নেই। আমি লিখেছিলাম, শেখ হাসিনার পতনের পর কি হতে পারে, কাদের হাতে দেশ যাবে- সে বিষয়ে কারোর ধারণা নেই। হাসিনা সরকারকে কি আমি সমর্থন করেছিলাম?
২০১৩ সালের পর্যন্ত লীগকে প্রগতিশীল ব্লগার (অনলাইন লেখক) প্রায় সকলেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও সেক্যুলারিজমের কারণে সাপোর্ট করতো, আমিও করতাম। হ্যাঁ করতাম, অতীত কাল। যদিও লীগের ধর্ম নিয়ে খেলা, ৯৬ সালের মাথায় কালো কাপড় বেধে নামাজী-চরিত্র নিয়ে নিন্দা করতাম। তবু মন্দের ভালো হিসেবে আওয়ামী লীগের বিকল্প আমাদের ছিল না।
কিন্তু ব্লগার কিলিংয়ের পর আরো অনেকের মত আমারও লীগের প্রতি মিথটা ভেঙে পড়ে। সেই দিনগুলিতে ব্যক্তিগতভাবে আমার জন্য কী পরিমাণ আতংকের ছিল সেটা অন্য কেউ বুঝবে না। রাস্তায় বেরিয়ে আমাকে বারবার ফিরে ফিরে তাকাতো হতো কেউ রেকি করছে কিনা। ঘরে বন্দি ছিলাম দিনের পর দিন। তখন শেখ হাসিনা কার্যত ব্লগারদের জীবন বিপন্ন করে জঙ্গিদের ধরার বদলে ব্লগারদের নিরাপত্তা দিতে অস্বীকার করেন। তাদের লেখালেখি তো বটেই তাদের বেঁচে থাকারই যেন এদেশে অধিকার নেই।
পুরোনো কাসুন্দি না ঘাটি আর। শেখ হাসিনার নিন্দা করা লেখার অভাব নেই আমার। এখন কী ঘটছে কী হতে যাচ্ছে- সেটা নিয়ে ভাবি। আমার ধারণা বাংলাদেশ অবশ্যই কাগজে-কলমে ইসলামিক দেশ হিসেবে জানান দিবে না। তবে দেশটা হেফাজত-জামাত চক্রের হাতে চলে যাবে। আসলে চলে গেছে। এখন প্রতিটি হত্যা, সংখ্যালঘু নির্যাতন, শিল্প-সংস্কৃতির উপর আক্রমণগুলিকে এই আন্দোলনের সেইসব মানুষগুলো যারা জামাত-শিবির নন, লীগের অপশাসনে অতিষ্ঠ ছিলেন- তারা সাফাই গাইছেন। এগুলোকে লীগের অপপ্রচার বলছে। কেউ মানুষের দীর্ঘদিনের ক্ষোভের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া বলে বৈধতা দিচ্ছে। কেউ কেউ এরকম হওয়াটা উচিত বলে সোজাসাপ্টা জানিয়ে দিচ্ছে। তাদের দিন আসবে। সেদিন তাদের উপর ঘটা অন্যায়গুলোরও প্রতিবাদ আমি করবো। যে ছাত্র-বিপ্লব ঘুষের টাকায় রাজনৈতিক মোড় নিয়ে যায়, সেই বিপ্লব তো তখনই বিক্রি হয়ে গেছে। জামাত-হেফাজতের শাসনে কারা কারা সংস্কৃতি, লেখালেখি, শিল্পকলা আর আধুনিক জীবনাযাপন চলাফেরার স্বাধীনতা পাবেন- সেটাও বড় আগ্রহ নিয়ে দেখবো। সেদিনের সেই স্বাধীনতার আন্দোলন কিন্তু আপনার একার হবে! এই ছাত্র সামাজ আর এই জনগণ কিন্তু ওয়াজের পাখিদের ফ্যান-ফলোয়ার! কেউ থাকবে না আপনার লড়াইয়ে।
কোন দল বা পক্ষ আমার নেই। আমার রাজনৈতিক বিশ্বাস আছে, কিন্তু কোন পার্টি নেই। আপনাদের জামাতী বিপ্লবের উপর তাই আমি 'মুতে' দেই! দেশের সেক্যুলারিজম প্রগতিশীলতার শেষ ইটটিও এই 'বালের' প্রজন্ম খুলে নিয়ে বুড়িগঙ্গায় ফেলবে!