মধ্যপ্রাচ্যে সংকট বাড়লে, যুদ্ধ বিস্তৃত ও দীর্ঘায়িত হলে বাংলাদেশে অর্থনৈতিক সংকট বাড়বে৷ রপ্তানি খাতে ও মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশের শ্রম বাজারেও তার নেতিবাচক প্রভাব পড়ার শঙ্কা বিশ্লেষক এবং ব্যবসায়ীদের৷
ছয় মাসেরও বেশি সময় ধরে গাজায় ইসরায়েলের অভিযানে মধ্যপ্রাচ্যে সংকট এমনিতেই ঘনিভূতহচ্ছিল৷ সিরিয়ার দামেস্কে ইরানি কনস্যুলেটে হামলার প্রতিশোধ হিসেবে সম্প্রতি ইসরায়েলে ইরানের ড্রোন এবং রকেট হামলায় পরিস্থিতি আরো উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে৷
এ নিয়ে বাংলাদেশেও অস্বস্তি তৈরি হয়েছে৷ বিশেষ করে অর্থনীতি, বৈদেশিক বাণিজ্য এবং জ্বালানি তেল নিয়ে সংকটের আশঙ্কা করা হচ্ছে৷ বুধবার মন্ত্রিসভার বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংশ্লিষ্ট সব খাতকে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিতে বলেছেন৷ সংঘাত দীর্ঘ হলে জ্বালানি তেলসহ যেসব খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে সেই সব খাতকে তিনি পরিকল্পনা ও ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন৷ বাণিজ্যমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু ডয়চে ভেলেকে জানান, জ্বালানি, ভোগ্যপণ্য আমদানির ক্ষেত্রে তারা বিকল্প অনুসন্ধান শুরু করেছেন৷
যেসব ক্ষেত্রে প্রভাব পড়বে
বাংলাদেশে জ্বালানি তেল আমদানির ক্ষেত্রে মধ্যপ্রাচ্যের ওপর নির্ভরশীল৷ এলএনজি বা তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসও আসে এই অঞ্চল থেকে৷ যুদ্ধ বিস্তৃত হলে খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার শঙ্কা রয়েছে৷ এতে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালনি খাতে সমস্যা দেখা দেবে, শিল্প উৎপাদন ও পরিবহণ খাত ক্ষতির মুখে পড়তে পারে৷ নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বাংলাদেশের আমদানি ও রপ্তানি বাণিজ্যে। মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশের শ্রম বাজারেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা৷ সেইসঙ্গে বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ আরো কমে যেতে পারে৷
বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার্স অ্যাসোসিয়েশনের সহসভাপতি খায়রুল আলম বলেন, ‘‘সারাবিশ্বে যে জাহাজগুলো জ্বালানি তেল বহন করে তারা চার ভাগের একভাগ হয় হরমুজ প্রণালি দিয়ে। আর আমাদের জ্বালানির জন্য আমরা মধ্যপ্রাচ্য নির্ভর৷ সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার, বাহরাইন, দুবাই থেকে জ্বা লানি তেল আসে৷ কাতার থেকে আসে এলএনজি৷ এগুলো পরিবহণের জন্য রয়েছে দুইটি পথ হরমুজ প্রণালি ও লোহিত সাগর (রেড সি)৷ লোহিত সাগর শুধুমাত্র সৌদি আরবের জন্য কিছুটা সহজ৷ কিন্তু অন্যদের জন্য হরমুজ প্রণালি৷ এখন লোহিত সাগরে হুতিদের হামলা আর যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়লে হরমুজ প্রণালি বন্ধ হয়ে যাবে৷ ফলে বাংলাদেশ জ্বালানি তেল ও এলএনজির সংকটে পড়বে৷ এটা সারাবিশ্বের জন্য সংকট হবে৷''
তিনি জানান, দুবাই থেকে বাংলাদেশে নির্মাণ কাজের জন্য বিটুমিন ও পাথর আসে৷ অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে প্রবাসীদের জন্য বাংলাদেশ থেকে ভোগ্য পণ্য, শাবসবজি রপ্তানি হয়৷ সমুদ্রপথে সমস্যা হলে তাও বন্ধ হয়ে যেতে পারে৷
তিনি বলেন, ‘‘বাংলাদেশের রিফাইনারিতে সর্বোচ্চ এক মাসের চাহিদা পূরণের তেল রাখা সম্ভব৷ ফলে বেশি আমদানি করে রাখাও সম্ভব নয়৷ আর এই তেল-গ্যাসের উপর বিদ্যুৎ, শিল্প কারাখানা নির্ভরশীল৷''
পোশাক খাতে উদ্বেগ
যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়লে বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাক রপ্তানি কমে যেতে পারে। প্রথমত জ্বালানি সংকট তৈরি হলে উৎপাদন কমে যাবে৷ আবার রপ্তানির পথ ঝুঁকিপূর্ণ হলে লিড টাইম বা গন্তব্য দেশে তা পৌঁছাতে বেশি সময় লাগবে৷ এর ফলে পোশাকের খরচ বাড়বে৷ সেই সঙ্গে চাহিদাও কমে যেতে পারে৷ তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকরা জানান, লোহিত সাগরে জাহাজে হুতি বিদ্রোহীদের হামলার কারণে একটি নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে৷ পোশাক সরবরাহের লিড টাইম কোথাও কোথাও বেড়েছে৷ এখন যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়লে পরিস্থিতির আরো অবনতি হবে৷
বিজিএমইএ-এর সহ-সভাপতি শহীদুল্লাহ আজিম বলেন, ‘‘আমাদের পোশাক খাতের অবস্থা খারাপ হচ্ছে৷ অ্যামেরিকার বাজারে পোশাক রপ্তানি ২৪ শতাংশ কমে গেছে৷ ইউরোপের বাজারেও পোশাক রপ্তানি কমছে৷ চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে এক দশমিক ২৪ শতাংশ কমেছে৷ এখন যুদ্ধ বিস্তৃত হলে এটা আরো কমবে৷ বিশ্বব্যাপী অস্থিরতা তৈরি হলে পোশাক কেনা তারা কমিয়ে দেবে৷
তিনি বলেন, ‘‘আমাদের কাঁচামাল আমদানি কঠিন হয়ে পড়বে৷ দাম বেড়ে যাবে৷ উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে৷ এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে শিল্প উৎপাদনে৷''
অপ্রচলিত বাজারে সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি বাড়ছে৷ কিন্তু যুদ্ধের কারণে সেখানেও নেতিবাচক প্রভাবের আশঙ্কা করেন তিনি৷
মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশে পোশাক রপ্তানি বাড়ছে৷ পোশাক রপ্তানির শীর্ষ ১০ নতুন বাজারের দুটি হচ্ছে সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই) ও সৌদি আরব৷ চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে ইউএই ও সৌদি আরবে তৈরি পোশাক রপ্তানি বেড়েছে যথাক্রমে ৩৭ ও ৪৭ শতাংশ৷ তবে যুদ্ধ বিস্তৃত হলে এই বাজার কতটা টিকবে তা নিয়ে আশঙ্কা আছে তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকদের৷
দুশ্চিন্তায় শিল্প উৎপাদন থেকে বিনিয়োগ
গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘পলিসি এক্সচেঞ্জ অব বাংলাদেশ'-এর চেয়াম্যান ড. মাশরুর রিয়াজ বলেন, ‘‘মধ্যপ্রাচ্যে যে সংকট চলছে তার প্রভাব বাংলাদেশে কতটা হবে তা নির্ভর করছে কয়েকটি বিষয়ের ওপর৷ ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে যদি যুদ্ধ লেগে যায়, এটা যদি আঞ্চলিক যুদ্ধে পরিণত হয় এবং এই যুদ্ধ প্রলম্বিত হলে আমাদের অর্থনীতিতে সরাসরি দুইটি নেতিবাচক প্রভাব পড়বে৷ প্রথমত, আমাদের মূল জ্বালানি হলো তেল৷ আর এরজন্য আমরাসহ বিশ্ব মধ্যপ্রাচ্যের ওপর নির্ভরশীল৷ রাশিয়া ছিলো৷ কিন্তু ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সেটা কাজে লাগানো যাচ্ছে না৷ এছাড়া আমরা এলএনজি আনি মধ্যপ্রাচ্য থেকে৷ এখন এই পরিস্থিতিতে ওই বাজার অস্থির হয়ে যাবে৷ দাম বেড়ে যাবে৷ ফলে আমাদের এখানে পণ্য উৎপাদন, শিল্প উৎপাদন, পরিবহণ সবখানে খরচ ও দাম বেড়ে যাবে৷ এটা রপ্তানিতেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে৷''
বাংলাদেশের তৈরি পোশাকসহ যেসব শিল্প উৎপাদন গ্যাস বিদ্যুৎ নির্ভর সেখানে সমস্যা হবে৷ আর মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে বাংলাদেশের শ্রমবাজারেও প্রভাব পড়তে পারে বলে মনে করেন তিনি৷
তিনি জানান, ‘‘সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশ এখন বাংলাদেশে বিনিয়োগে আগ্রহী৷ সৌদি আরব প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ পরিকল্পনা করছে বাংলাদেশে৷ যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে এই বিনিয়োগ আমরা নাও পেতে পারি৷''
সিপিডির গবষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘‘জ্বালানি তেল নিয়ে আমরা এরইধ্যে চাপে আছি৷ এখন যদি যুদ্ধ পরিস্থিতি চলতে থাকে ইরান ইসরায়েলের এই অবস্থায় তৎপরতা আরো বাড়ে তাহলে জ্বা লানি তেল নিয়ে আমরা আরো চাপে পড়ব, এলএনজি নিয়েও চাপে পড়বো৷ তার প্রভাব অমাদের অর্থনীতির অনেক ক্ষেত্রেই পড়বে৷''
এই পরিস্থিতিতে মূল্যস্ফীতি আরো বাড়ার আশঙ্কা করেন তিনি৷
সংকট কতটা সামাল দেয়া যাবে?
ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘‘আসলে আমাদের অভ্যন্তরীণ নির্ভরতা বাড়াতে হবে৷ কৃষিতে যেরকম আমরা অভ্যন্তরীণ উৎপাদনে অনেক এগিয়ে তেমনি অন্য খাতেও প্রয়োজন৷ কিন্তু জ্বালানি খাতে তো আমরা আমদানি নির্ভর৷ শিল্পের কাঁচামালের জন্যও আমাদের নিজস্ব উৎপাদনে যেতে হবে৷ আর সরকারি ও বেসরকারি অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ কমাতে হতে পারে৷''
ড. মাশরুর রিয়াজ বলেন, ‘‘আমাদের জ্বালানির জন্য বিকল্প সোর্সের দিকে যেতে হবে৷ সিংগাপুর, অষ্ট্রেলিয়ার কথা ভাবা যেতে পারে৷ আগাম জ্বালানি কিনে রাখা যায়৷ যদি বিকল্প পথে জ্বালানি আনতে হয় তার খরচ এখনই হিসাব করা দরকার৷ তবে এসব করে পরিস্থিতি কিছুটা সামাল দেয়া গেলেও সংকট হবেই৷''
বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু জানান, সরকার এরইমধ্যে ভোগ্যপণ্য, জ্বালানি বিকল্প উপায়ে কীভাবে আনা যায় তার পরিকল্পনা করছে৷ সমুদ্রপথে সংকট দেখা দিলে উড়োজাহাজের রপ্তানি পণ্য পাঠানোর চিন্তা করছে সরকার৷ বলেন," আমরা তৈরি পোশাক রপ্তানিতে আকাশ পথ ব্যবহার শুরু করেছি৷ আমরা এজন্য কার্গো উড়োজাহাজ কেনার পরিকল্পনা করছি৷ প্রয়োজনে এয়ার শিপমেন্ট বাড়িয়ে দিব৷''
ভোগ্যপণ্যের জন্য মিয়ানমারের সঙ্গে চুক্তির পরিকল্পনা এবং আসিয়ান দেশগুলোর সঙ্গে যোগাযোগে করা হচ্ছে বলে জানান৷
জ্বালানি তেলের ব্যাপারে প্রয়োজনে রাশিয়ার আগের প্রস্তাবগুলো পরীক্ষা করে দেখা হবে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘‘আমাদের বিকল্প সোর্স তো লাগবে৷ আর এখন অভ্যন্তরীণভাবে কিছু জ্বালানি তেল আমরা পাচ্ছি৷ আরো বিকল্প দেশের কথা ভাবা হচ্ছে৷''
তিনি বলেন," পরিস্থিতির ওপর সরকার নজর রাখছে৷ আমরা সব ধরনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি৷''