বের হচ্ছে ভয়ংকর সব তথ্য, কিডনি-অঙ্গ পাচারের অভিযোগ, রাতের আঁধারে দাফন, হদিস নেই ৮৩৫ লাশের, মৃত্যুসনদ বানাতেন নিজেই
মানবিক মুখোশের আড়ালে ভয়ংকর সব অপকর্মের অভিযোগ ওঠায় মিল্টন সমাদ্দারকে ঘিরে রহস্যের সৃষ্টি হয়েছে। অসহায় মানুষকে আশ্রয় দেওয়ার নামে তাদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিক্রি করা, ৮৩৫টি লাশের কোনো হদিস না পাওয়া, আশ্রমে টর্চার সেলের সন্ধানসহ গা শিউরে ওঠার মতো আরও সব অপরাধের খবরে হতবাক পুলিশ ও গোয়েন্দারা।
‘চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ার’ আশ্রমের চেয়ারম্যান এই মিল্টন সমাদ্দারের সব রহস্য উদঘাটনে তৎপর গোয়েন্দারা। মিল্টনকে তিন দিনের রিমান্ডে নিয়ে গোয়েন্দা পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। এর আগে ১ এপ্রিল বুধবার রাতে রাজধানীর মিরপুর থেকে মিল্টনকে গোয়েন্দা পুলিশ গ্রেফতার করে। রাতেই তার বিরুদ্ধে তিনটি মামলা দায়ের করা হয়।
গোয়েন্দা পুলিশ প্রধান ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার বলেন, মিল্টন সমাদ্দারের বিরুদ্ধে অজস্র অভিযোগ। রাতের আঁধারে লাশ দাফন করতেন। সিটি করপোরেশনের মৃত্যুসনদও নিজেই তৈরি করতেন। এভাবে রাতের আঁধারে প্রায় ৯০০ লাশ দাফনের ভুয়া মৃত্যুসনদ নিজেই তৈরি করেছেন। এমন ভুয়া সিলসহ কাগজপত্র উদ্ধার করা হয়েছে। এ ব্যাপারে মিল্টন কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি। জানা যায়, তার বাড়ি বরিশালের উজিরপুরে। তিনি তার বাবাকে পেটানোর কারণে এলাকাবাসী তাকে এলাকাছাড়া করে। এরপর ঢাকায় চলে আসেন। তিনি বলেন, মিল্টন ঢাকায় এসে শাহবাগের একটি ফার্মেসিতে কাজ শুরু করেন। সেখানে ওষুধ চুরি করে বিক্রির কারণে মিল্টনকে বের করে দেওয়া হয়। এরপর একজন নার্সকে বিয়ে করেন। বিয়ের পর ‘চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এজ কেয়ার’ স্থাপনের জন্য স্ত্রীর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করেন।
জানা যায়, মিল্টনের ২টা আশ্রম রয়েছে। সাভারের আশ্রমে ৫ থেকে ৭০০ লোক রয়েছে বলে মিল্টন জানিয়েছেন। কিন্তু খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সেখানে ২০ থেকে ৩০ জনের বেশি লোক নেই। তার আশ্রমে যে অপারেশন থিয়েটার রয়েছে এর মাধ্যমে কিডনি বিক্রি করেছেন কিনা তাও তদন্ত করা হবে। জানা গেছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীদের কাছে মানবতার ফেরিওয়ালা হিসেবে মিল্টন সমাদ্দারের নাম বেশ পরিচিত। মানবতার সেবক হিসেবে তার পাঁচটি ফেসবুক পেজে অনুসারীর (ফলোয়ার) সংখ্যা প্রায় ২ কোটি। গড়ে তুলেছেন ‘চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এজ কেয়ার’ নামের বৃদ্ধাশ্রম। রাস্তা থেকে অসুস্থ কিংবা ভবঘুরেদের কুড়িয়ে আশ্রয় দেন। তাদের নিয়ে ভিডিও তৈরি করে প্রায়ই তাকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করতে দেখা যায়। মানুষের অসহায়ত্ব তুলে ধরে তাদের জন্য বিত্তবানদের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করেন। তার আবেদনে সাড়াও মেলে প্রচুর। মোবাইল ব্যাংকিংয়ের ১৬টির বেশি নম্বর এবং তিনটি ব্যাংক হিসাবে প্রতি মাসে প্রায় কোটি টাকা জমা হয়। এর বাইরে অনেকেই তার প্রতিষ্ঠানে সরাসরি অনুদান দিয়ে আসেন। মানবিক কাজের জন্য এখন পর্যন্ত তিনটি রাষ্ট্রীয় পুরস্কারও পেয়েছেন মিল্টন সমাদ্দার। কিন্তু এরপরই তার বিরুদ্ধে বেরিয়ে আসতে থাকে ভয়ংকর সব অপরাধের তথ্য। তার বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগগুলোর অন্যতম হলো, অসহায় মানুষকে আশ্রয় দেওয়ার নামে তাদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিক্রি করা। এমনকি তার পরিচালিত আশ্রমে তিনি যে কজনকে লালন-পালন করছেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন জায়গায় তারচেয়ে কয়েক গুণ প্রচার করেন। এ ছাড়াও লাশ দাফন করার যে হিসাব তিনি নিয়মিত দিয়ে থাকেন, তাতেও বিরাট গরমিলের অভিযোগ রয়েছে।
লাশ কাটা ছেঁড়ার দাগ: মিল্টন সমাদ্দারের দক্ষিণ পাইকপাড়া আশ্রমের কাছেই বায়তুর সালাম জামে মসজিদে এক সময় তার প্রতিষ্ঠানে নিয়ে আসা লাশ বিনামূল্যে গোসল করানো হতো। তার মানবিক কাজে উদ্বুদ্ধ হয়ে মসজিদ কর্তৃপক্ষ তাকে এ সুবিধা দিয়েছিল। তবে গোসল করানোর সময় দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা প্রায় প্রতিটি লাশের বিভিন্ন স্থানে কাটাছেঁড়ার দাগ শনাক্ত করেন। করোনার সময় এ বিষয়ে মিল্টন সমাদ্দারকে প্রশ্ন করে মসজিদ কর্তৃপক্ষ। এরপর তিনি ওই মসজিদে লাশ পাঠানো বন্ধ করে দেন। পুলিশ এ বিষয়টিও তদন্ত করে দেখছে।
মিল্টন সমাদ্দারের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ:
মিল্টন সমাদ্দারের বিরুদ্ধে সবচেয়ে গুরুতর অভিযোগ হলো, তিনি মিডিয়ায় ৯০০ মরদেহ দাফনের দাবি করলেও অনুসন্ধানে মাত্র ৬৫টি মরদেহ দাফনের তথ্য মিলেছে। বাকি মরদেহ তিনি ঘুষ দিয়ে গোপনে দাফন করার দাবি করলেও সে দাবির কোনো ভিত্তি পাওয়া যায়নি। কারণ ‘চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ার’র প্যাডে ইস্যু করা ডেথ সার্টিফিকেটেই বৈধভাবে মরদেহ দাফনের প্রমাণ রয়েছে। এ ছাড়াও তার বিরুদ্ধে মানুষের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিক্রি, হাসপাতালের অনুমোদন না থাকার পরও আশ্রমের ভেতরে অপারেশন থিয়েটার স্থাপন এবং নিজেই অপারেশন করা, হাসপাতালে চিকিৎসা না দিয়ে মৃত্যু পর্যন্ত অপেক্ষা করা, ডাক্তারের সিল ও স্বাক্ষর জাল করে ডেথ সার্টিফিকেট তৈরি, টর্চার সেলে মানুষকে মারধর, গভীর রাতে মরদেহ দাফন, দাফনের ক্ষেত্রে কোনো আইনকানুন না মানা, এমনকি বিষয়টি কাছের থানা পুলিশকে অবহিত না করা, নামসর্বস্ব মিল্টন হোম কেয়ার প্রাইভেট লিমিটেড নামের একটি কোম্পানি থেকে মাসে ৬-৭ লাখ টাকার ভিত্তিহীন আয় দেখানো, আশ্রমের ভেতরে বসে মাদক সেবন করে বয়স্কদের মারধরসহ অসংখ্য অভিযোগ পাওয়া গেছে। তার আশ্রমে মারধরের শিকার হওয়ার কয়েক দিন পর মারা যান একজন বয়স্ক ব্যক্তি। তিনি বিভিন্ন মাধ্যমে তার আশ্রমে ৩শর বেশি অসহায় মানুষ থাকেন বলে দাবি করলেও প্রকৃতপক্ষে সব মিলিয়ে একশজনও নেই।
এসব অপকর্ম করতে তিনি বিভিন্ন প্রভাবশালী রাজনীতিক ও সরকারি কর্মকর্তাদের নাম ব্যবহার করতেন। এ ছাড়াও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নাম বলেও তিনি স্থানীয় সাধারণ মানুষকে হুমকি-ধমকি দিয়েছেন।
বাংলাদেশের খ্রিষ্টান সম্প্রদায়কে নিয়ন্ত্রক হতে চেয়েছিলেন মিল্টন:
জোর করে ক্ষমতার অপব্যবহার করে মিল্টন সমাদ্দার খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের নিয়ন্ত্রক হতে চেয়েছিলেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। সেই লক্ষ্যে মিল্টন সমাদ্দার, তার ভাই লিটন সমাদ্দার এবং আত্মীয়স্বজন মিলে একের পর এক গির্জার নিয়ন্ত্রণ নিতে শুরু করেন। এক্ষেত্রে তারা প্রথমেই সুকৌশলে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের সিল ও স্বাক্ষর জাল করেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মিল্টন সমাদ্দার প্রথমে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের নথিপত্র জাল করে নিজে গির্জা পরিচালনার জন্য একটি কমিটি গঠন করেন। এরপর সেই কমিটির অনুলিপি পাঠানো হয় সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসকের কাছে। এরপর দলবল নিয়ে গিয়ে চার্চের ভেতরে থাকা যাজকদের বের করে দিয়ে দখল করে নিয়ে নেন। এ প্রক্রিয়ার প্রথমে মিল্টনরা দখলে নেন রাজধানীর গ্রিন রোডের ফেলোশিপ চার্চ। এই চার্চের কমিটিতে মিল্টন সমাদ্দারের বড় ভাই লিটন সমাদ্দার রয়েছেন।
ফেলোশিপ চার্চের সম্পাদক প্রফেসর সরা বৈদ্য বলেন, ‘মিল্টন গংরা পথভ্রষ্ট। ওরা আমাদের মারধর করে জোর করে চার্চ থেকে বের করে দিয়ে দখলে নিয়েছে। যাজকরা চার্চ তালাবদ্ধ করে বসেছিলেন। ওরা ১৪টি তালা ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করেছে। মারতে মারতে যাজকদের চার্চ থেকে বের করে দিয়েছেন। আমরা পুলিশে অভিযোগ দিলেও পুলিশ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।’
প্রশ্ন হচ্ছে, মিল্টন সমাদ্দারের পাপ-পুণ্যের কোন পাল্লাটা ভারী? মিল্টন জানতো, তার অপকর্ম আড়াল করতে হলে বড় একটি ধর্মীয় ব্যানার লাগবে। সেজন্য সে খৃস্টান সম্প্রদায়কে নিয়ন্ত্রণে নিতে চেয়েছিলো, কিন্তু ভুল পথে। সে সফল হয়নি। ভিডিওটি দেখুন: