কলকাতার উগ্রবামপন্থিরা শেখ হাসিনার পদত্যাগ চাইছে কেন?

জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ২০২৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর রাশিয়া পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া যাখারোভা এক ব্রিফিংয়ে পরিষ্কারভাবে বলেছিলেন, আসন্ন নির্বাচনে যদি আওয়ামী লীগ জয়ী হয়ে সরকার গঠন করে তাহলে আমেরিকা এই সরকারকে হটাবার জন্য সব রকমের চেষ্টা করবে।

‘জুলাই তাণ্ডবে’র আড়ালে ষড়যন্ত্রের স্বরূপ দেখল বাংলাদেশ। শিক্ষার্থীদের ‘কোটা সংস্কার’ আন্দোলনের নামে রাস্তায় নেমে দেশে যে তাণ্ডবলীলা চালানো হয়েছে, সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ভিলেন বানানো হয়েছে- তা শুধু বাংলাদেশ নয়; দক্ষিণ এশিয়ার কোনো দেশেই দেখা যায়নি। সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন হতেই পারে। কিন্তু ছাত্রদের ‘ব্ল্যাকমেইল’ করে ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় আন্দোলনের নামে দুষ্কৃতকারীরা যেভাবে হিংসাত্মক ঘটনা ঘটিয়েছে- তা একটি ক্ষমতাধর দেশের ‘নতুন পরিকল্পনা’ বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

তারা বলছেন, তরতর করে এগিয়ে যাওয়া বাংলাদেশের সবরকম ক্ষতি করার জন্য নতুন ওই ষড়যন্ত্র কাজে লাগানো হয়েছিল। ওই পরিকল্পনা এমনভাবে বিস্তৃত করা হয়েছে যা বাংলাদেশের তৃণমূল পর্যন্ত ছড়িয়ে গেছে, যার ফলে দেশজুড়ে ‘জুলাই তাণ্ডব’ ঘটানো সম্ভব হয়েছে। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। প্রসঙ্গত, কোটা সংস্কার আন্দোলনে ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচিকে ঘিরে গত ১৮ ও ১৯ জুলাই দেশজুড়ে তাণ্ডবলীলা চলে।

বিশ্লেষকরা বলেছেন, গত ডিসেম্বরে রাশিয়া আমেরিকাকে টার্গেট করে বাংলাদেশকে ভবিষ্যৎবাণী করে বলেছিল, জানুয়ারিতে নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ বিজয়ী হলে বাংলাদেশে ছাত্রবিক্ষোভ হবে এবং আরব বসন্তের মতো পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। যদিও ওই সময় আমেরিকা রাশিয়ার এমন কথার প্রতিবাদ করেছিল। তবে বাংলাদেশকে ঘিরে রাশিয়া-আমেরিকার এমন বাক্য বিনিময়ের পরিপ্রেক্ষিতে কড়া নজর রেখেছিল প্রতিবেশী ভারত। আর সতর্ক ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও। তবু ছাত্রদের কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে, তা বোঝা যায়নি। ফলে এত বড় নাশকতা ঘটাতে পেরেছে ষড়যন্ত্রকারীরা। বিদেশি শক্তির সঙ্গে দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক, অরাজনৈতিক সংগঠন এবং বেশ কিছু ব্যবসায়ীর ষড়যন্ত্রের ফলে জুলাই তাণ্ডব হয়েছে।

জানতে চাইলে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ও কূটনৈতিক বিশ্লেষক শমসের মবিন চৌধুরী বলেন, সময় মতো ঠিকঠাক পদক্ষেপ নিলে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে জাতিসংঘের মাধ্যমে তদন্তের আহ্বানকে স্বাগত জানিয়ে তিনি বলেন, ঠিকঠাক তদন্ত হলে বাইরের কোনো হাত এতে জড়িত আছে কি না- তা বেরিয়ে আসবে। এই ঘটনায় বিদেশি কোনো শক্তির হাত থাকতে পারে, এটা নিশ্চিত প্রমাণ না পাওয়ার আগ পর্যন্ত মন্তব্য করা ঠিক হবে না।

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, কোটা সংস্কার আন্দোলনের তীব্রতা কমে আসার সঙ্গে সঙ্গে ষড়যন্ত্রের স্বরূপ কেমন ছিল তা সামনে আসছে। কীভাবে এই বিষয়টিকে একটি ক্ষোভের কন্টেন্ট করা যেতে পারে এবং তা কারা ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পেরেছিল, শিক্ষার্থীদের সামনে রেখে কারা এই জ্বালাও-পোড়াও করেছিল, মানুষ মেরে কারা উল্টো করে ঝুলিয়ে রেখেছিল, কারা পেছন থেকে গুলি করেছিল- তাও বেরিয়ে আসছে। কারা আন্দোলনে থাকা ‘প্রজন্ম’কে ভুলভাবে উপস্থাপন করল, কারা নেট দিল? কারা এত সাহায্য করল নেপথ্যে? কারা কাছে এসে উসকে দিল? শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে কারা সবরকমের রসদ জুগিয়েছিল, তীব্র গরমে কারা ঠাণ্ডা পানি সরবরাহ করেছিল- তাও সরকার জেনে গেছে। তদন্ত যত এগুচ্ছে ততই সরকার মনে করছে, এই ষড়যন্ত্রের পেছনে দেশি-বিদেশি চক্রান্ত জড়িত। কারণ, পুলিশ পেছন থেকে গুলি করে মানুষ মারেনি। এজন্য এই আন্দোলনে কে কীভাবে মারা গেছেন, তার তথ্যও প্রকাশ করবে সরকার। এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই এই ঘটনার আন্তর্জাতিক তদন্ত দাবি করেছেন। তাদের মতে- এই ঘটনার স্বরূপ ঠিকভাবে উন্মোচিত হলে ‘ভূরাজনীতির’ বহু হিসেব উল্টে যেতে পারে।

গত বৃহস্পতিবার এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, দেশ যখন উন্নতির শিখরে উঠছে, তখন পাকিস্তানের প্রেতাত্মারা ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে। তারা সব মেগা প্রকল্পে হামলা চালিয়েছে। আমি জানি বারবার আঘাত আসবে। আমি পরোয়া করি না। আল্লাহ জীবন দিয়েছেন, একদিন নিয়েও যাবেন। কিন্তু যেখানে মানুষের জন্য কল্যাণের কাজ, সে কল্যাণের কাজ আমরা করেই যাব। আমরা শিক্ষার্থীদের দাবি শতভাগ মেনে নিয়েছি। দাবি মানার পর আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার কি যৌক্তিকতা আছে?

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঠিক জায়গায় দৃষ্টি দিয়েছেন। কারণ, বাংলাদেশে সবশেষ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ২০২৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর রাশিয়া পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া যাখারোভা এক ব্রিফিংয়ে পরিষ্কারভাবে বলেছিলেন, আসন্ন নির্বাচনে যদি আওয়ামী লীগ জয়ী হয়ে সরকার গঠন করে তাহলে আমেরিকা এই সরকারকে হটাবার জন্য সব রকমের চেষ্টা করবে। সব রকমের চেষ্টার কথা বলতে গিয়ে যে কয়টি চেষ্টা মারিয়া উল্লেখ করেন তার মধ্যে আশ্চর্যের ব্যাপার ছিল- ইউনিভার্সিটি-কলেজ-স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের মাধ্যমে নির্বাচনের পর বাংলাদেশে একটা ছাত্রবিক্ষোভ হবে এবং আরব বসন্তের মতো অবস্থা তৈরি হবে। জুলাইতে এসে এই বিক্ষোভের দেখা মিলেছে। রাশিয়ার দেয়া ১৫ ডিসেম্বরের সেই বিবৃতি রাশিয়া তার রাষ্ট্রীয় ওয়েবসাইট থেকে মুছে ফেলেছে। যদিও এই বিষয়ে মার্কিনিরা প্রতিবাদ করেছিল এবং এগুলোর সঙ্গে তাদের সম্পর্ক নেই বলে জানিয়েছিল। সেই সময় বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেনও রাশিয়ার এমন তথ্যকে উড়িয়ে দিয়েছিলেন।

জানতে চাইলে না প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক বলেন, জুলাই তাণ্ডবের সঙ্গে অবশ্যই ‘ভূরাজনীতির’ জটিল হিসাব জড়িত আছে। আন্দোলনের নামে যা যা ঘটেছে তা একে একে জোড়া দিলে সব তথ্য পরিষ্কার হয়ে যাবে বলে মনে করেন তিনি। তার মতে, ছাত্র আন্দোলন ছিল উপলক্ষ। মূল লড়াই ছিল- সরকার উৎখাত করা। তিনি বলেন, ষড়যন্ত্রে এই প্রজন্মের সন্তানরা পা দিয়েছে। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি, মুক্তিযুদ্ধের পরের সময় দেখেনি। মার্কিন-পাকিস্তান ষড়যন্ত্রে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড এবং তার পরবর্তী ঘটনাও খুব জানে বলে মনে হয় না। কারণ, সরকার ছাত্রদের দাবি মানার পরও তারা কেন রাস্তায় থাকবে। তারা নতুন দাবি দিয়েছে। এসব দাবি পূরণে সময় দিতে হবে তো? কিন্তু তারা না করে এখনো রাস্তায় আছে, উদ্দেশ্য কি? কারা তাদের উসকে দিচ্ছে?

বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গত ১৮ ও ১৯ জুলাই শিক্ষার্থীদের কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচিতে পরিকল্পিতভাবে সহিংসতার পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে। এদিন আন্দোলনকারীদের সঙ্গে মিশে দুষ্কৃতকারীরা ‘তুর্কি’ নাচন নাচিয়ে দেয়। এদের টার্গেট ছিল পুলিশকে ভিলেন বানানো। পুলিশকে ভিলেন বানানোর পাশাপাশি ব্যবসায়ীদেরও উসকে দেয়া হয়। পরবর্তীতে প্রবাসীদেরও উসকানো হয়- যাতে তারা দেশে টাকা না পাঠান। কারণ তাদের উদ্দেশ্য ছিল- অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশকে পঙ্গু করে দেয়া। পাশাপাশি বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করাও ছিল তাদের মিশন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সরকারের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করছে ঢাকাসহ বাংলাদেশে। কিন্তু মিছিল হচ্ছে কলকাতায় এবং সেই মিছিলে স্লোগান দেয়া হচ্ছে- ‘শেখ হাসিনার সরকার, আর নেই দরকার’। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, শেখ হাসিনার সরকারের পদত্যাগ কেন কলকাতার উগ্র বামপন্থিরা চাইবেন? এতেই তো বোঝা যায়, ষড়যন্ত্র কোথা পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। তবে ভারত সরকার অত্যন্ত সুন্দর মন্তব্য করেছে জানিয়ে তিনি বলেন, দেশটির মন্তব্য বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, দিল্লি সত্যিই আমাদের প্রতিবেশী মনে করে।

তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, কোটা সংস্কার আন্দোলনের পর এরই মধ্যে ঢাকায় ভারত, জাপান, ইতালিসহ বেশ কয়েকটি দেশের রাষ্ট্রদূতরা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেছেন। যুক্তরাষ্ট্র এই ঘটনায় বাংলাদেশকে শুধু দোষারোপই করে যাচ্ছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঢাকায় নিযুক্ত রাষ্ট্রদূতদের নিয়ে ধ্বংসস্তূপ দেখিয়েছে। এরই মধ্যে গত সোমবার নিয়মিত প্রেস ব্রিফিংয়ে এক প্রশ্নের জবাবে চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র লিন জিয়ান বলেন, বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এসেছে। সামাজিক শৃঙ্খলা আবার শুরু হয়েছে। বাংলাদেশের বন্ধু ও ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী হিসেবে চীনা পক্ষ এতে আনন্দিত। তিনি আরো বলেন, চীন ও বাংলাদেশ ব্যাপক কৌশলগত সহযোগিতামূলক অংশীদার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চীন সফরের সময় দুই দেশের নেতাদের মধ্যে যে গুরুত্বপূর্ণ সাধারণ সমঝোতা পৌঁছানো হয়েছিল, দুই দেশের মধ্যে ব্যাপক কৌশলগত সহযোগিতামূলক অংশীদারত্বকে আরো গভীর করতে এবং দুই দেশের জনগণকে আরো সুবিধা দিতে চীন বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করতে প্রস্তুত রয়েছে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন