দেশ এখন দেশদ্রোহীদের হাতে বিপন্ন
তসলিমা নাসরিন
১.
গণঅভ্যুত্থানে স্বৈরাচারী সরকারের পতন হয়েছে। কিছু লোক দাবি করছে, এটি একটি মুক্তিযুদ্ধ, দাবি করছে- যারা পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছে, তারা শহীদ। একে মুক্তিযুদ্ধ নাম দিয়ে ৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধকে অপমান কি না করলেই নয়! বলা হচ্ছে, দেশ ''স্বাধীন'' হয়েছে। না, দেশ আগেও স্বাধীন ছিল না, স্বাধীন এখনও নয়। দেশ এখন দেশদ্রোহীদের হাতে বিপন্ন। যারা দেশের সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর পুড়িয়ে ছাই করে দিচ্ছে, যার ফলে হাজারো সংখ্যালঘু দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হচ্ছে, যারা পুড়িয়ে ছাই করে দিচ্ছে, দেশের জাদুঘর, পাঠাগার, একাডেমি, থিয়েটার, সিনেমাহল, ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দিচ্ছে ভাষ্কর্য, মনুমেন্ট, যারা মানুষের বাড়িঘর লুট করছে, বাড়ি ঘরে চুরি ডাকাতি করছে- তারা দেশদ্রোহী ছাড়া কিছু নয়।
দেশের মাটি অনেককাল থেকেই কামড় দিয়ে রেখেছে মৌলবাদী এবং জিহাদি অপশক্তি। তিরিশ বছরের নির্বাসন থেকে আমি যদি দেশে ফিরতে পারি, যদি প্রাণের ভয়ে ভিন দেশে পাড়ি দেওয়া মুক্তচিন্তক, যুক্তিবাদী, নিরীশ্বরবাদীরা দেশে ফিরতে পা্রে, যদি সংখ্যালঘুরা তাদের ফেলে যাওয়া ভিটেমাটিতে ফিরতে পারে, নির্ভয়ে নিরাপদে দেশে বাস করতে পারে, তবেই দেশকে বলা যায় স্বাধীন। তার আগে নয়।
২.
দেশ জুড়ে ধ্বংসযজ্ঞ আর হত্যাযজ্ঞ শেষে সশস্ত্র ''জাগ্রত জনতা'' এখন সারা দেশে ডাকাতি করতে ব্যস্ত। পুলিশ থেকেও নেই, আর্মি থেকেও নেই। শেষঅবধি কিছু আর্মি নাকি গিয়েছে ডাকাতি থামাতে। ভয়ে ভয়ে। কারণ নতুন প্রজন্ম সরকার ফেলে দিতে পারে, এমনই শক্তিমান, তাদের আর্মিও ভয় পায়। সে কারণে আর্মিও তাদের স্বাধীনতায় বাধা দিচ্ছে না। তাদের চুরি-ডাকাতি, রাহাজানি, খুন-খারাবি করার স্বাধীনতা খুব বড় স্বাধীনতা। ডাকাতি করবে না কেন? ডাকাতি তো উম্মতদের রক্তে। নিশ্চয়ই তারা ''পেছন থেকে শত্রুকে আক্রমণ করার'' কায়দা-কানুন সব শিখে নিয়েছে।
৩.
রাহুল আনন্দের বাসভবন, তাঁর সমস্ত বাদ্যযন্ত্র পুড়িয়ে দিয়েছে জামাত-শিবিরের ''জাগ্রত'' জনতা। রাহুল আনন্দ প্রচুর বাদ্যযন্ত্র আবিষ্কার করে ছিলেন। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট যখন বাংলাদেশে যান, মনে আছে তিনি আর কোথাও যাননি কিছু দেখতে, রাহুল আনন্দের বাড়ি গিয়েছিলেন তাঁর বাদ্যযন্ত্রগুলো দেখতে। সেই অত্যাশ্চর্য প্রতিভা রাহুল আনন্দকে দেশান্তরি হতে হয়েছে, নিশ্চয়ই তিনি আর পোড়া দেশে ফিরবেন না। তাঁর স্বপ্ন পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।
এই দেশে তারেক জিয়া কী করে বাস করবে? শিবিরের সন্ত্রাসীরা তার দাড়ি নেই বলে, মাথায় টুপি নেই বলে তাকে তো খোলা রাস্তায় কোপাবে। মানুষ মারায় হাতে খড়ি তো ওদের হয়েই গেছে। আর যে ছাত্রীরা জিন্স টপ পরে গান গেয়েছিল, এক দফা আন্দোলন করেছিল, তাদেরও তো অন্দরমহলে ঢুকে যেতে হবে, ঘরের বাইরে বেরোলে বোরখা পরে বেরোতে হবে। পিনাকি ভট্টাচার্যর পিনাসের কী হবে? আগা না কাটলে তো তাকেও কোপানো হবে।
জনবিচ্ছিন্ন হাসিনা সরকারের পদত্যাগ ঠিক ছিল, তবে তাঁকে দেশ ছাড়া করার সিদ্ধান্ত ঠিক ছিল না। এখন, মবোক্রেসিকে কন্ট্রোল করবে কে? শুনেছি, হাসিনার কোলে যারা বসে থাকতো এতদিন, হাসিনাকে ভগবান বলতো, সবাই এখন হাসিনাকে ডাইনি বলছে। কেউ কেউ বলল, ১৮০ ডিগ্রি না ঘুরলে বাংলাদেশে বেঁচে থাকা সম্ভব নয়।